মরুকরণের মুখে উত্তরের জীবনরেখা

# পানিশুন্য তিস্তায় চাষাবাদ ব্যাহত, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট থেকে:

তিস্তা নদীর হারানো যৌবন ফেরাতে এবং ভারতের একতরফা নদী দখলের কবল থেকে রংপুর অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার উৎস তিস্তা নদীকে রক্ষায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ভারতের নদী আগ্রাসনে পানির অভাবে সর্বগ্রাসী খরস্রোতা তিস্তা আজ পরিণত হয়েছে ধু-ধু বালুচরে।

বর্তমানে তিস্তা নদী প্রায় পানিশূন্য। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চর জেগে উঠেছে, ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ। বিপাকে পড়েছেন জেলে ও মাঝি সম্প্রদায়। একসময় এই নদীর পানির উপর নির্ভর করে ধান, গম, ভুট্টা, সবজি সহ নানা ফসল ফলাতেন কৃষকেরা। এখন হাঁটুর নিচে পানি, কোথাও পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে নদী।

পানি সংকটের কারণে কৃষকেরা এখন ডিজেল চালিত সেচ পাম্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করে চাষাবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে কৃষকের লোকসান হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, লালমনিরহাটের তিস্তা চরাঞ্চলে প্রায় ৯ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ ৩ থেকে ৪ হাজার কিউসেক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে মাত্র ৪-৫ শত কিউসেক পানি প্রবাহিত হচ্ছে, যা চাহিদার তুলনায় অতি সামান্য। ফলে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

ভারতের সিকিম থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে প্রবেশ করা তিস্তা নদী এখন জীবন রক্ষার পরিবর্তে জীবিকার সংকটে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দাবি থাকলেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন থমকে আছে।

বর্ষাকালে নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ব্যাপক বন্যা ও ভাঙনের সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হন। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে মরুকরণের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি তিস্তার প্রাণ ফিরিয়ে আনার দাবিতে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ভার্চুয়ালি তারেক রহমান তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান।

তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, “উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদী। প্রতিবেশী দেশের নদী আগ্রাসন ও সরকারের উদাসীনতায় আজ এই নদী বিপন্ন। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে উত্তরের কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনমান ধ্বংস হয়ে যাবে।”

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, “তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। চায়না পাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। শিগগিরই তিস্তা পাড়ের মানুষ এর সুফল পাবেন।”

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুধু একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয় — এটি উত্তরের মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। দ্রুত ও কার্যকর বাস্তবায়নই পারে উত্তরাঞ্চলের কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে।