শিল্প থেমে থাকে না সে যেমন সময়ের আবর্তে নিজেকে নবায়ন করে, তেমনি একজন শিল্পীর শেখার পরিধিও নিরন্তর প্রসারিত হয়। আমি প্রদীপ সাহা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে পেইন্টিং বিষয়ে বিএফএ (অনার্স) ও এমএফএ (মাস্টার্স) ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো আমার সৃজনযাত্রা।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত ২১তম নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীতে চিত্রকলায় মাধ্যম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করি সেটা ছিলো আমার শিল্প জীবনের এক দীপ্তিময় প্রহর, যেন এক কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতির আলোকচ্ছটা।
এরপরের সময়টা কাটে একজন ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবে। স্বাধীনতা যেমন আনন্দের, তেমনি অনিশ্চয়তারও। তবে সৃষ্টিশীলতার ধারায় কখনো বিরতি ছিল না। এই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ২২ মার্চ, আমি কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে শিক্ষক (প্রভাষক) হিসেবে যোগদান করি। সে দিনটি আমার জীবনে ছিলো এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে শিল্প ও শিক্ষা মিশে যায় এক গভীরতর বন্ধনে।
শিক্ষকতা পেশায় এসে আমি উপলব্ধি করি একজন শিক্ষককে কেবল জ্ঞান বিতরণকারী হিসেবে ভাবলে চলবে না, বরং তাকে হতে হয় সময়-সচেতন, প্রযুক্তি-সক্ষম ও মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ এক অগ্রপথিক। শিক্ষার্থীদের হৃদয় জয়ের জন্য প্রয়োজন নতুনত্ব, প্রয়োজন মাল্টিমিডিয়ার সংবেদনশীল প্রয়োগ। আর এই পথচলায় যিনি আমার অন্তর্নিহিত আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন, তিনি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম।
ড. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম শুধু একজন শিক্ষক নন তিনি এক প্রজ্ঞাময় পথপ্রদর্শক, যার একাডেমিক জীবনের বর্ণিল ভ্রমণ শুরু হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রে। এরপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুশাসন আইন বিষয়ে পিএইচডি অর্জন এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ডাকোটায় ইনস্ট্রাকশনাল ডিজাইন বিষয়ে এমএস অধ্যয়ন এই দীর্ঘ অভিযাত্রা তার আজীবন শেখার প্রতীক।

প্রায় দুই যুগের শিক্ষকতা জীবনে তিনি কেবল পাঠদানই করেননি, বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বীজ বপন করেছেন নিরন্তর নিষ্ঠায়। কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা তাঁর উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব রূপ, যেখানে তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ড. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম বিশ্বব্যাংকের হেকেপ প্রকল্পসহ একাধিক প্রশাসনিক দায়িত্বে সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতৃত্বের এই ভূমিকা কখনো কঠোরতা নয়, বরং ছিলো মানবিক দূরদর্শিতার মেলবন্ধন। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান যুগোপযোগী ও রূপান্তরমূলক। তিনিই সেই ব্যক্তিত্ব, যিনি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে চলেন নীরবে, কিন্তু গভীর প্রভাব রেখে যান শিক্ষার্থীদের মনে।
এই আলোর পরশেই আমি ধন্য হই ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল, যখন তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুক প্রোফাইল) ঘোষণা দেন যে, ‘ক্যারিয়ার পোর্টফোলিও প্রিপারেশন’ শীর্ষক একটি ওয়েববেজড কোর্স পরিচালনা করবেন। আমি বুঝে যাই এটা হতে যাচ্ছে একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। সীমিত ২০ জন লার্নারের জন্য সেই কোর্সে ২২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে আমি অনলাইনে (গুগল ফর্ম) নিবন্ধন করি এবং আমার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে এতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করি।
২৩ এপ্রিল ২০২৪ আমি ইমেইলের মাধ্যমে কোর্সের নির্দেশনা পাই এবং লগইন করি টেলেন্ট এলএমএস নামক একটি আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্মে। সেখানে চোখে পড়ে ড. ইসলামের অসাধারণভাবে বিন্যস্ত কোর্স কাঠামো: ওভারভিউ, উদ্দেশ্য, টুডু লিস্ট, ফাইনাল প্রজেক্ট গাইডলাইন, ডিসকাশন বোর্ড, ফমমেটিভ ইভ্যুলুয়েশন, রেকর্ডেড লেকচার, টিপিটি প্রেজেন্টেশন, উপস্থাপনা, ও মূল্যায়ন রুবরিক্স প্রভৃতি। একঝলকে বুঝতে পারি এটা কোনো সাধারণ কোর্স নয়; এটি শিল্পিত পরিকল্পনার নিটোল বহিঃপ্রকাশ। এটা ছিলো নিজ উদ্যোগে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত কোর্স। তিনটি মডিউলে বিন্যস্ত এই কোর্স সর্বসাকুল্যে ১ ঘন্টার ছিলো। এই কোর্সের মাধ্যমে জীবনে প্রথম বারের মত আমি একটি অনলাইন সেলফ পেইসড কোর্সে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। কীভাবে একজন নবীন পেশাজীবী তাঁর পোর্টফোলিও তৈরি করবে এবং তার শৈল্পিক দিক সুন্দরভাবে উপস্থাপিত ছিলো এই কোর্সে। কোর্সের অভিজ্ঞতা ও নির্দেশনার আলোকে আমি আমার জন্য একটি ই-পোর্টফোলিও তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং ক্যানভা প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিই। তৈরি করে ফেলি নিজের একটি সৃজনশীল, তথ্যবহুল ও দৃষ্টিনন্দন ডিজিটাল পোর্টফোলিও। সেখানে স্থান পেয়েছে আমার শিল্পকর্ম, শিক্ষাগত পথচলা ও পেশাগত অভিজ্ঞতার গল্প। এটি শুধু একটি পোর্টফোলিও নয় এ যেনো আমার আত্মপরিচয়ের এক দৃষ্টিশোভন অনুবাদ। ইচ্ছা করলে যে কেউ আমার ই-পোর্টফোলিৗ পরিদর্শন করতে পারেন।
এই পথচলারই এক স্বাভাবিক সম্প্রসারণ ছিল ১০ জুন ২০২৪ তারিখে রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউএসি আয়োজিত অনলাইন রিফ্রেসার্স কোর্সে (৯ম রিফ্রেসার্স কোর্স) অংশগ্রহণ। ইউএসএ থেকে সিনক্রোনিয়াস মুডে এই ট্রেনিং কোর্সটি পরিচালনা করেন ড. মো. জহুরুল ইসলাম। এই প্রশিক্ষণের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী পর্ব ছিল: ‘মালটিমিডিয়া লার্নিং এন্ড স্টডেন্ট এনগেজমেন্ট।’ এই সেশনে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন আধুনিক শিক্ষাতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি ও মাল্টিমিডিয়ার বিশ্লেষণাত্মক ব্যবহারের সাথে। রবার্ট গানিয়ে’র ‘নির্দেশনার নয়টি ঘটনা’, জন কেলারের ‘প্রেরণার এআরসিএস মডেল’ এবং রিচার্ড মায়ারের ‘মাল্টিমিডিয়া লার্নিংয়ের জ্ঞানীয় তত্ত্ব’। এসব তত্ত্ব শুধু তথ্যভিত্তিক ছিল না, বরং ছিল প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর।
ড. ইসলাম দেখান কিভাবে শ্রবণ ও দৃশ্য উপকরণের সম্মিলনে শিক্ষাকে অধিক কার্যকর, আকর্ষণীয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়। আমি এখন চেষ্টা করি ক্লাসে প্রজেক্টর, অ্যানিমেটেড ভিডিও, ডিজিটাল স্কেচ ও ইন্টারঅ্যাক্টিভ কনটেন্ট ব্যবহার করতে। শিক্ষার্থীদের চোখে এখন যে উজ্জ্বলতা দেখি, তা নিঃসন্দেহে মাল্টিমিডিয়ার সেই নতুন সংস্পর্শের ফল। শ্রেণিকক্ষ এখন শুধু একমুখী জ্ঞান বিতরণের স্থান নয়; এটি হয়ে উঠেছে একটি প্রাণবন্ত, জিজ্ঞাসাময় ও কৌতূহলোদ্দীপক ক্ষেত্র। শিক্ষার্থীরা এখন আর শুধুই শ্রোতা নয় তারা হয়ে উঠেছে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তারা প্রশ্ন করে, বিশ্লেষণ করে, এবং ক্লাস শেষে বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করে।
পরিশেষে বলতে চাই ড. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলামের সাথে আমার অভিজ্ঞতা কেবল একটি কোর্স বা ট্রেনিং ছিলো না, বরং ছিলো আমার শিক্ষক সত্তার আত্মউন্মোচনের এক নব রূপকথা। ডিজিটাল পোর্টফোলিও তৈরির মাধ্যমে আমি যেমন নিজের শিল্প ও শিক্ষক পরিচয়কে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে পেরেছি, তেমনি মাল্টিমিডিয়ার শক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে আরো জীবন্ত, প্রাসঙ্গিক ও অনুপ্রাণিত শিক্ষক হয়ে উঠেছি। এ যাত্রায় ড. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম এর সান্নিধ্য, দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা আমাকে যে আলোকপথ দেখিয়েছে তা নিঃসন্দেহে আজীবনের সম্পদ। আশা করি শিক্ষার মৌলিক তত্ত্ব ও শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটাল লার্নিং প্রয়োগে ড. ইসলাম ভবিষ্যতে অসামান্য অবদান রাখবেন যা আমার মত উদীয়মান এবং নব্য শিক্ষকের জন্য ভীষণরকমের অনুপ্রেরণার হবে।
স্বাআলো/এস