কমরেড লেনিনের জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবনা

| April 22, 2025

২২ এপ্রিল ২০২৫—আজ কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনটি কেবল এক বিপ্লবীর জন্মদিন নয়, এটি স্মরণ করার দিন—এক মহান চেতনার, এক অনমনীয় সংগ্রামের, এক সাহসী বিকল্প দর্শনের। যে দর্শন আজকের বাংলাদেশেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ এই দেশেও শোষণ-নিপীড়ন, বৈষম্য ও রাজনৈতিক প্রতারণার করাল ছায়া দিনদিন গভীরতর হচ্ছে।

লেনিন বলেছিলেন—
“বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোনো বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না।”
এই তত্ত্বের আলোকেই তিনি ১৯১৭ সালে শ্রমিক ও কৃষকের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব ঘটান, যার ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে একটি শ্রমিক শ্রেণি কর্তৃক পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়—গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ববাদ, উন্নয়নের নামে বৈষম্য, এবং স্বাধীনতার নামে শোষণের নতুন রূপ। একদিকে করপোরেট পুঁজির উত্থান, অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নিরাপত্তার অভাব, ন্যায্য মজুরির অনুপস্থিতি, কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, যুবসমাজের বেকারত্ব, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, এবং বিরোধী মত প্রকাশের অধিকার হরণ—এগুলো সবই আজকের বাংলাদেশকে এক নতুন ধরনের সাম্রাজ্যবাদের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

আজকের বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানি, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের শর্ত, বিদেশি বিনিয়োগের নামে স্বার্থ বিসর্জন এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতার মাধ্যমে এই সাম্রাজ্যবাদ নতুন রূপে হাজির হয়েছে।

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কাছে জনগণের মৌলিক অধিকার বারবার গৃহীত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় জনগণের দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্নে তেমন মনোযোগ নেই। একদিকে চরম দুর্নীতি, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেসরকারিকরণ এবং প্রতিরোধহীন নব্য-সাম্রাজ্যবাদী দখলনীতি ক্রমাগত জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলছে।

এমন প্রেক্ষাপটে, সমাজতান্ত্রিক চেতনার পুনরুত্থান প্রয়োজন। মানুষের ভিতরে রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা, সত্য ইতিহাস ও বিকল্প দর্শনের চর্চা, সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা—এই চেতনা এখন সময়ের দাবি। আমরা ভুলে যেতে পারি না, লেনিন বলেছিলেন—
“একটি বিপ্লব অসম্ভব যদি না বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।”

আমরা সেই বিপ্লবী পরিস্থিতির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। দেশের জনগণ রাজনৈতিক ক্লান্তি, পুঁজিবাদী ছলনার প্রতি বিতৃষ্ণা এবং বিকল্প নেতৃত্বের খোঁজে দিন দিন আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই চেতনার নেতৃত্ব কে দেবে? কে হবে লেনিনের মতো সেই সংগঠক, যে তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে মানুষকে পথ দেখাবে?

আমাদের নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে হবে—বিপ্লব কেবল বন্দুক হাতে নেওয়া নয়, বরং জ্ঞান, সংগঠন ও আদর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামো পাল্টানোর কাজ। লেনিন বারবার শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলতেন—
“রাজনীতির বাইরে থাকাটাই আসলে রাজনীতি।”
অর্থাৎ, রাজনীতির বাইরে থাকলে কেউ নিরপেক্ষ থাকে না; বরং চুপ থাকা মানে শোষকের পক্ষ নেওয়া।

বাংলাদেশে আজ প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত, আদর্শভিত্তিক, শ্রেণি-সচেতন রাজনৈতিক বিকল্প—যা পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্তৃত্ববাদের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলতে সক্ষম। এমন একটি আন্দোলন, যা শহরের বস্তি থেকে গ্রামের মাঠ, কল-কারখানা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব জায়গায় শোষিত মানুষদের মধ্যে আদর্শের বীজ বপন করবে।

লেনিন বলেছিলেন—
“বিশ্বাস ভালো, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ আরও ভালো।”
সেই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে হবে রাজনৈতিক সংগঠনের ভেতরেও—যাতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব নয়, গণতান্ত্রিক কাঠামো ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে।

বর্তমানে যখন তরুণ সমাজ ক্রমেই হতাশাগ্রস্ত, তখন তাঁদের সামনে একটি আদর্শ, একটি দিকনির্দেশনা অত্যন্ত জরুরি। লেনিনের জীবন ও দর্শন সেই দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তিনি শেখান কীভাবে একটি নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কৌশল, সংগঠন, তত্ত্ব ও জনতার শক্তি দিয়ে বদলে দেওয়া যায়।

এই জন্মবার্ষিকীতে তাই আমাদের অঙ্গীকার হোক—
“এই বাংলাদেশে প্রতিটি শ্রমজীবী পরিবারে একজন করে লেনিন হয়ে উঠুক।
তাঁর মতো স্পষ্টভাষী, সংগ্রামী, সাহসী এবং সংগঠিত হোক আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ।
মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ—এই তিন ধারার মিলিত শক্তি হোক পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মূল হাতিয়ার।”

লেখক: দেবু মল্লিক, সংবাদকর্মী