জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার রবিবার কঠোর অবস্থানে যায়। এদিন এক নির্দেশনায় এনবিআরের অধীন সব পর্যায়ের চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে রাতে আন্দোলনকারীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’সহ সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
সরকারের এমন কঠোর অবস্থানের পরই রবিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাসান তারেক রিকাবদার।
তিনি বলেন, ‘পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় সমঝোতার ভিত্তিতে আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।’
গত মে মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআরকে বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের অধ্যাদেশ জারি করে। এরপর থেকেই এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংস্কার পরিকল্পনার বিরোধিতা ও চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামেন। জুনের মাঝামাঝি সাময়িক স্থগিত থাকার পর ২২ জুন থেকে তারা পুনরায় কর্মসূচি শুরু করেন।
এনবিআরে আন্দোলনরতদের দ্রুত কাজে ফেরার নির্দেশ, অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা
শনিবার এবং রবিবার টানা দুইদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচির ফলে জাতীয় রাজস্ব আদায় কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এতে শুধু তৈরি পোশাক খাতেই দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
এর আগে রবিবার বিকেলে আন্দোলনকারী এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টার বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, সেটিও সরকার বাতিল করে দিয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ পরিষ্কারভাবে বলেন, ‘যদি আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা শাটডাউন চালাতে চান, তাহলে করুক। সরকার আলাপ-আলোচনার দরজা খোলা রেখেছিল, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।’
রবিবার দুপুরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা জানান, এনবিআরের শাটডাউন ইস্যু নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত হয়েছে, ‘ আজ (রোববার) কোনো বৈঠক করা হবে না। ১ জুলাইয়ের প্রস্তাবিত বৈঠকও অনিশ্চিত।’
এর আগে এনবিআরের সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর ক্যাডারের ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দল গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার। তারা বিকেল চারটায় বৈঠকে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত মে মাসে জারি করা এক অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন, যেখানে এনবিআরকে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনাÑদুই বিভাগে ভাগ করা হয়। চলমান আন্দোলনে তাদের মূল দাবিÑ এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগ এবং সংস্কার পরিকল্পনা বাতিল। শনিবার থেকে তারা ‘সম্পূর্ণ শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন।
দুদক জানিয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হয়।
এনবিআরের ছয় কর্মকর্তা হলেন আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম; নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার; ঢাকা-৮ কর অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা; ঢাকা কর অঞ্চল-১৬ অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা; ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কণ্ডু এবং বিএসএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনবিআরের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
এনবিআর সূত্র বলছে, অনুসন্ধানের মুখে পড়া অন্তত পাঁচ কর্মকর্তা এনবিআরের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি। এই ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এনবিআরে আন্দোলন চলছে। মির্জা আশিক রানা ও শাহরীন সুস্মিতা ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি।
দুদকের ভাষ্যমতে, তারা বছরে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি ঘটিয়েছেন বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে অংশ নিয়ে।
রোববার সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এনবিআর কর্মকর্তাদের চলমান আন্দোলন পরিকল্পিত ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী। তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রবিবার বিকেলে সরকারের অপর এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতীয় স্বার্থে অতি জরুরি আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রম সচল রাখার জন্য এনবিআরের অধীনস্থ সব শ্রেণির চাকরি অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস হিসেবে ঘোষণা করা হলো।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘এ ঘোষণা অমান্য করে শাটডাউন বা ধর্মঘট চালিয়ে গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
স্বাআলো/এস