অর্থনীতির সংকটে কৃষিই হতে পারে বাংলাদেশের ভরসার স্তম্ভ

খন্দকার মনিরুল হায়দার: বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট এপ্রিল ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে দেশের দারিদ্র্যের হার ২২.৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যেখানে ২০২২ সালে এটি ছিলো ১৮.৭ শতাংশ। এতে আরো বলা হয়েছে, চলতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাসের সঙ্গে দ্বিমত করছেন না দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তারা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে অতিরিক্ত ঋণ, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে অর্থনীতির ভীত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক মন্দা, রফতানি হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট এবং মূল্যস্ফীতির চাপ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে আরো অস্থির করে তুলেছে।
এই সংকটকালীন মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে কীভাবে? আমাদের মতে, এই প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে ‘কৃষি’ খাতে।
কৃষির বর্তমান অবদান ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি কেবল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়, বরং এটি জীবিকা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৭ শতাংশ এখনো কৃষি খাতে নিয়োজিত এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (GDP) এই খাতের অবদান প্রায় ১১.২ শতাংশ।
কমরেড লেনিনের জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবনা
বাংলাদেশে বর্তমানে বার্ষিক ধান উৎপাদন প্রায় ৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা দেশের মোট খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে যথেষ্ট। তবে এই উৎপাদন থেকে প্রকৃত লাভবান হচ্ছেন না কৃষকরা। কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির জটিলতা এসবই আজ কৃষি খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
সংকট থেকে উত্তরণে কৃষিতে বিনিয়োগ অপরিহার্য
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জ্বালানি সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের টিকে থাকার অন্যতম পথ হতে পারে কৃষি উৎপাদন ও রপ্তানি। অথচ কৃষিখাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের মাত্র ৪.৭৫ শতাংশ, যা আমাদের কৃষি নির্ভর দেশের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি ১ টাকা কৃষি ভর্তুকি থেকে প্রায় ৪.৫ টাকা সমপরিমাণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক রিটার্ন পাওয়া সম্ভব।
যা করতে হবে এখনই
১. কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে: আধুনিক ও ডিজিটাল বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলে কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে।
২. কৃষিঋণ সহজলভ্য করতে হবে: ব্যাংকিং জটিলতা ও দালালচক্রের প্রভাব কমিয়ে সরাসরি কৃষকদের ঋণ দিতে হবে।
৩. রপ্তানির সুযোগ বাড়াতে হবে: বাংলাদেশে উৎপাদিত অর্গানিক সবজি, মধু, চা, ফলমূল আন্তর্জাতিক বাজারে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন মানসম্মত প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্র্যান্ডিং ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা।
৪. জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে: ক্রমবর্ধমান বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ইত্যাদি কৃষির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
৫. কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন গড়ে তুলতে হবে: কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে পচনশীল খাদ্যের অপচয় কমবে এবং কর্মসংস্থানও বাড়বে।
পরিশেষে বলি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই সময় বড় বড় অবকাঠামো বা বিদেশি বিনিয়োগের আশায় বসে না থেকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সেই খাতে, যেটা বাস্তবিক অর্থেই জনগণের অর্থনীতি কৃষি। এটি শুধু উৎপাদন নয়, বরং কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি।
এই বাস্তবতা অনুধাবন করে আসন্ন বাজেটে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রণোদনা, বিনিয়োগ ও আধুনিকীকরণ এই তিন মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে কৃষিই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ভরসার নাম।
স্বাআলো/এস