প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান বিস্তারিত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রস্তাবিত বিভিন্ন সংস্কার আলোচনায় তারা কোন কোন প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে এবং কোনগুলোতে দ্বিমত প্রকাশ করেছে।
রবিবার (৬ জুলাই) রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব তথ্য তুলে ধরেন। এসময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও নজরুল ইসলাম খান তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে জনগণের মধ্যে যেমন আগ্রহ ও প্রত্যাশা আছে, তেমনি হতাশা ও উৎকণ্ঠাও রয়েছে। বিএনপি ছয়টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে এবং ঐকমত্য কমিশনের প্রতিদিনের আলোচনায় কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করছে। তিনি জানান, ঐক্যমতে পৌঁছানোর জন্য বিএনপির প্রতিনিধিরা অন্যান্য দলের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছেন এবং অনেক বিষয়ে ছাড়ও দিয়েছেন। তবে দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো কিছু প্রস্তাব পেশ করার পরও বিপরীত বা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ায় কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব বিভিন্ন সংস্কার কমিশন নিয়ে তাদের অবস্থানের বিস্তারিত তুলে ধরেন:
পুলিশ সংস্কার কমিশন: এই কমিটির বিষয় এখনও আলোচনায় আসেনি। তবে দলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে জানা গেছে, র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দুদক সংস্কার কমিশন: কতিপয় ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের মধ্যে ৪৬টিতে বিএনপি সম্মতি জানিয়েছে। কেবল ২৯ নম্বর সুপারিশে আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে আদালতের অনুমতি নেওয়ার বিদ্যমান বিধান বহাল রাখার কথা বলেছে বিএনপি। তাদের মতে, এটি না হলে দুদকের কার্যক্রমে অহেতুক বিলম্ব হতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন: ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে ১৮৭টিতে বিএনপি একমত, পাঁচটিতে আংশিক একমত এবং পাঁচটিতে ভিন্নমত দিয়েছে। ১১টি প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি বিএনপি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রদেশ সৃষ্টি এবং পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয় (যেখানে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে)।
বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন: ৮৯টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে ৬২টিতে বিএনপি একমত, ৯টিতে আংশিকভাবে একমত এবং ১৮টিতে ভিন্নমত পোষণ করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ক সব প্রস্তাবে একমত হলেও কিছু বিষয় নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন বা সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন: ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে বিএনপি একমত, ১৪টিতে আংশিকভাবে একমত এবং ৬৪টিতে ভিন্নমতসহ একমত (আইন ও বিধিতে সংশোধনী প্রস্তাব)। ২৪টি বিষয়ে একমত হতে পারেনি বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, এই ২৪টি প্রস্তাবের কয়েকটি বাস্তবসম্মত নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আনীত সব প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে। আইনি সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন: ১৩১টি সুপারিশে বিএনপি দফাভিত্তিক মতামত দিয়েছে এবং অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ‘৭০’ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করার বিষয়ে বিএনপি ছাড় দিয়েছে ঐকমত্যের স্বার্থে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনেও বিএনপি সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য হয়েছে। জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার বিষয়েও বিএনপি সম্মত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা এবং নির্বাচনী এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার বিষয়েও বিএনপি একমত। বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মত হলেও এটি বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি, কারণ পূর্বের এমন উদ্যোগ আদালত বাতিল করেছিল।
মির্জা ফখরুল বলেন, অনেক সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি শুধুমাত্র ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে একমত হয়েছে, যদিও সেগুলোর বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুরূহ এবং উদ্দেশ্য অর্জন প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি যুক্তিসঙ্গত মতামত দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।
তিনি আরো বলেন, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও নিত্যনতুন এমন সব প্রস্তাব আসছে, যেগুলো রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংসদ পরিচালনায় বিপুল প্রভাব ফেলবে। এসব প্রভাব ইতিবাচক হলে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব বা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন করার অধিকার কোনো ব্যক্তি, দল বা কমিশনের আছে কিনা, তা বিবেচনায় নিতে হবে। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বলে বিএনপি এই মুহূর্তে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে।
স্বাআলো/এস
