দেবু মল্লিক
১৮৮৬ সালের শিকাগো-বিশ্বের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত মাইলফলক। আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে রাস্তায় নামা হাজারো শ্রমিক রাষ্ট্রশক্তির গুলিতে রক্তাক্ত হয়েছিলেন। তবে এটি শুধু একটি আবেগময় স্মৃতিচিহ্ন নয়, এটি ছিলো শ্রমিক শ্রেণির সংগঠিত সংগ্রামের বাস্তব প্রয়াস। তাই মে দিবস মানে আবেগের নয়, বরং সংগঠিত শ্রেণী সংগ্রামের ঐতিহাসিক অভিপ্রায়।
কিন্তু আজ, ২০২৫ সালের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মে দিবসের রাজনীতি গভীর এক সংকটে। পুঁজিবাদ একদিকে শ্রমিক শ্রেণিকে প্রতিদিন শোষণ করছে, অন্যদিকে বিপ্লবের নামে অনেক ‘বাম রাজনীতি’ নিজেরাই রোমান্টিকতার ফাঁদে পড়েছে। বিপ্লবকে অর্থনৈতিক কাঠামো, রাষ্ট্র ও শ্রেণীভিত্তিক সংগঠনের পরিবর্তে অনেকেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাহসিকতার প্রদর্শনীতে পরিণত করেছেন। এই মোহ বিপজ্জনক। এটি বিপ্লবকে বাস্তব পথ থেকে বিচ্যুত করে কল্পনার আবরণে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
ভলাদিমির লেলিন ‘What Is To Be Done’ গ্রন্থে বলেছিলেন, বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোনো বিপ্লবী আন্দোলন সম্ভব নয়। কিন্তু আজ বিপ্লবের তত্ত্বগত ভিত্তি ছাড়াই নাটকীয় কর্মসূচি, নেতা নির্ভরতা ও বিক্ষিপ্ত প্রতীকী কর্মকাণ্ড সমাজ পরিবর্তনের নামে চালানো হচ্ছে। এর ফলে বিপ্লব কোনো সংগঠিত শ্রেণীচেতনার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারছে না।
আজ মহান মে দিবস, শ্রমিকের অধিকার আদায়ের দিন
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক প্রতিনিয়ত নিজের শ্রমের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। সে শ্রমের ‘দাম’ পেলেও, ‘মূল্য’ পায় না। এই পার্থক্য থেকেই উৎপন্ন হয় উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value)-যেটাই পুঁজিপতির লাভের উৎস। কার্ল মার্কস তার Das Kapital-এ লেখেন, শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের দ্বারা। (The value of labour-power is determined by the value of the means of subsistence necessary for the maintenance of the labourer. Capital, Vol. 1)। কিন্তু আজও শ্রমিক জানে না তার মজুরি কীভাবে নির্ধারিত হয়। তার মধ্যে তৈরি হয়নি সেই বোধ। কমিউনিস্ট রাজনীতির শত বছরের ইতিহাসেও এই সচেতনতা শ্রমিকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারাই আমাদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দুর্বলতা।
শুধু শ্রমিক নয়, কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। কারণ, সে জানে না তার উৎপাদনে মোট খরচ কত। জমিভাড়া, বীজ, সার, পানি, পরিবহনের সাথে পারিবারিক শ্রমের মূল্য কিভাবে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে যুক্ত হয় তা তাদের অজানা। এই খরচের হিসাব না জানার কারণে সে নিজের উৎপাদিত পণ্যের ‘মূল্য’র পরিবর্তে ‘দাম’ অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে নির্ধারণ করে। বাজারে দালাল শ্রেণি এই অজ্ঞতাকে পুঁজি করে কৃষকের উৎপাদনশক্তি শোষণ করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন বাম দল সময় সময় শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কথা বলে। কিন্তু সে মজুরি কী প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক ভিত্তি কী, তা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয় না। ফলে শ্রমিক শুধু এক ধরনের ‘উপরি দয়া’র আশায় থেকে যায়। সচেতন অধিকারভিত্তিক সংগ্রামের বদলে সে পরিণত হয় মজুরি নির্ধারিত অপেক্ষার এক নিষ্ক্রিয় শ্রেণিতে।
রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শোষণের প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রমিক ও কৃষককে সচেতন করাও মে দিবসের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। কারণ রাষ্ট্র নিরপেক্ষ নয়-এটি শোষকের হাতিয়ার। লেলিন তার State and Revolution-এ বলেন, ‘রাষ্ট্র হলো এক শ্রেণির দ্বারা অন্য শ্রেণিকে দমন করার যন্ত্র।’ বাংলাদেশে আদমজী জুটমিলসহ বহু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে শ্রমিকদের পথে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজকের রাষ্ট্র মুক্তবাজার অর্থনীতির দাসে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শ্রমিকের পক্ষে নয়, বরং মালিকের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। এই সত্যকে অস্বীকার করে মে দিবস উদ্যাপন মানে কেবল প্রতীকী অনুষ্ঠান।
কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস The Communist Manifesto-এ লিখেছিলেন, ‘প্রলেতারিয় আন্দোলন হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সচেতন, স্বাধীন আন্দোলন।’ (The proletarian movement is the self-con-scious, independent movement of the immense majority, in the interest of the immense majority. The Communist Manifesto, 1848)। কিন্তু আজ সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠছে না, কারণ শ্রেণিচেতনা জন্ম নিচ্ছে না, বিপ্লব হচ্ছে ব্যক্তিনির্ভর, নাটকীয়, রোমান্টিক-বাস্তবতার মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন।
মে দিবসের শিক্ষা তাই আমাদের নতুন করে বুঝতে হবে। এটি কেবল অতীত স্মরণ নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রস্তুতি। আবেগ, প্রতীক বা মিছিল নয়-এটি শ্রেণীসংগ্রামের কঠিন পথে সংগঠিত হবার আহ্বান। আজকের সংকট মোকাবিলায় করণীয় হচ্ছে-
শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে উৎপাদন খরচ ও মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা, মজুরির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা, শ্রমিক সংগঠনে রাজনৈতিক শিক্ষার পুনঃপ্রবর্তন করা এবং রাষ্ট্র কাঠামোকে বিশ্লেষণ করে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা।
এই হোক মে দিবসের শপথ।
লেখক: সংবাদকর্মী
স্বাআলো/এস