হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশায় বুক বাঁধছে তিস্তা পাড়ের মানুষ। শেখ হাসিনার চীন সফর শেষে ঘোষণা আসতে পারে। এই একটি মাত্র পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন চিত্র। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগে এখনো কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বিরোধীতা করেনি। বরং দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি করেছেন।
বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদী তিস্তা। ভারতের সিকিমের কানসি হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবেশ। চুংথাং থেকে সিঙ্ঘিক, টানা কুড়ি কিলোমিটার হিমালয়ের এই অংশটি অত্যন্ত খাড়া। এই এলাকাতে নদীর ঢাল প্রতি ৩০ মিটারে এক মিটার। সিঙ্ঘিকের পর থেকে তিস্তার ঢাল ক্রমশ কমে দাঁড়ায় প্রতি ১২০ মিটারে এক মিটার করে। জলপাইগুড়ি শহরের কাছে সেই ঢাল আরো কমে দাঁড়ায় এক কিলোমিটারে ০.৭ মিটার।
পরিবেশ কর্মীদের দাবি, নদীর ঢালের এই বৈচিত্রকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ পেতে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থা ‘এনএইচপিসি’-র অধীনে বন ও পরিবেশ দফতরের পরিবেশ সুরক্ষার গাইডলাইন না মেনেই তিস্তার উপরে সিকিমে চারটি বাঁধ তৈরি হয়। পাশাপাশি, সেচ ও পানীয় জল সরবরাহের জন্যেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ দফতরের তত্ত্বাবধানে থাকা ভারতের গজলডোবায় ‘তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প’-এর অধীনে ১৯৭৬ সাল থেকে চারটি বাঁধ, আর ৫৭.৯৭ কিলোমিটার ‘লিঙ্কড ক্যানাল’ বা সংযোগকারী খাল তৈরি হয়। একই সঙ্গে দুটো প্রকল্পের অধীনে একাধিক বাঁধ নির্মাণে নদীর চলার স্বাভাবিক ছন্দ সম্পূর্ণ বিঘ্নিত হয়েছে।
পাল্টে গিয়েছে তিস্তার জল ও পলি প্রবাহের স্বাভাবিক চরিত্র। বাংলাদেশে তিস্তা নদী প্রায় ৬৫ কিঃমিটার প্রবেশের পর পুনরায় বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ত সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের কারনে দোয়ানিতে বাঁধাগ্রস্থ হয়। এভাবে খরস্রোতা তিস্তায় কৃত্রিম ভাবে বাধা পেতে পেতে তিস্তার পানি প্রবাহের স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে। তিস্তা এখন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য আর্শীবাদ হতে অভিশাপে পরিণিত হয়েছে।
তিস্তা নদী তার পানি প্রবাহের স্বাভাবিক হতে না পেরে ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবর রাতে ভারতের ‘সিকিম উর্জা’ বা ‘স্টেজ ৩’ নামের বাঁধটি চুংথাং। হিমবাহ-গলা জলের চাপের বিস্ফোরণে মাত্র ১০ মিনিটের ভেঙ্গে যায়। কাদা-পলির ঘোলা জল নিয়ে সমতলে জমাট বাধায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিস্তা নদীর পানি বর্ষা মৌসুমে ভারত সঠিক ভাবে বাংলাদেমের ওপর দিয়ে প্রবাহিত করতে পারছে না। কারণ পলি জমে ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের ভাটির মুখে স্থান ভেদে ৫-৭ ফিট উঁচু হয়ে গেছে। ভারতে প্রবাহমান তিস্তার খাড়াইয়ে নির্মিত জলবিদ্যুত কেন্দ্রের পানি চাপ বেড়ে গেছে। একটু এদিক সেদিক হলেই ভেঙ্গে পড়ছে। সব চেয়ে বেশী ক্ষতির মুখে পড়ছে ভারত। পশ্চিমবঙ্গের সরকার শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারনে তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে সমঝোতায় আসছে না। কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি অনুধাবন করেছে। যার কারনে তিস্তা মহাপরিকল্পনা এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাপেরমুখে তিস্তা পানি চুক্তি ২০১১ সালে বাস্তবায়নের পথে বাধাগ্রস্থ হয়। সেই সময় হতে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা পানি চুক্তি বাস্তবায়নের চিন্তার পাশাপাশি তিস্তা নিয়ে বিকল্প চিন্তা শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। ২০২১ সালে তিস্তা মহা পরিকল্পনা এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। একই বছর মার্চে বাংলাদেশকে চীনা প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন জমা দেয়। দ্রুত তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে আগ্রহী তারা। বিনিয়োগেরও আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি। নড়েচড়ে বসে ভারত সরকার। ভারত ও চীনের জন্য ভৌগলিক অবস্থানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর (চীকেন নেক)। এই ভৌগলিক অবস্থানে পাশ দিয়ে তিস্তা প্রবাহমান। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনা অর্থ বিনিয়োগ ও চীনের তত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়ন ভারত
তাদের দেশের জন্য নিরাপদ মনে করছে না। আবার ভারত বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র হলেও তিস্তা প্রকল্পের বিষয় ভারত যদি বাংলাদেশের স্বার্থ না দেখে শুধুমাত্র তাদের স্বার্থ দেখে সে কারনে বাংলাদেশ একক ভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পার মত বৃহৎ পরিকল্পনা বা নদী শাসন করতে একক ভাবে ভারত কে দিতে চায় না। বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট না করলেও নদী বিশেষজ্ঞ গণ মনে করেন। এছাড়াও নদী শাসন ও নদীর পানি ম্যানেজম্যান্ট চীন, জাপান ও নেদারল্যান্ডের রয়েছে। ভারত সে দিক হতেও পিছিয়ে রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে প্রকল্প গ্রহনের সময় দেশের স্বার্থ সবার আগে প্রাধান্য দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। যার কারণে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল বৃহৎ প্রকল্প লাভজনক হয়েছে। দেশের মানুষ সুফল পাচ্ছে। কোন প্রকল্প ফল্ট করেনি। যেখানে শ্রীলংস্কার মতো দেশ বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সুফলের কারনে বিপর্যয়ে পড়েছে।
এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, তিস্তা নদীকে ঘিয়ে বিশাল এই প্রকল্পের কাজ পেতে ভারত ও চীনের মধ্যে একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে যায়। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্রুত কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই সফরের পর ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা অর্থের যোগানের বিশাল একটি অংশ অনুদান হিসেবে দিতে না- কি আগ্রহী। তিস্তা মহাপরিকল্পনা এখন চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক দোটানায় ঝুলে রাজিনয় বাংলাদেশ। বর্তমান সরকারের ভিতরের একটি প্রভাবশালী মহল চায়, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন-ভারত দুই দেশকে পাশে থাকুক। বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের প্রযুক্তিবিদদের যৌথ তত্ত্বাবধানে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হোক।
কি থাকছে তিস্তা মহাপরিকল্পনায়
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে ১০০০ মিটারে সীমাবদ্ধ করা হবে। নদীর গভীরতা বাড়বে ১০ মিটার। নদীশাসনের মাধ্যমে তিস্তা নদীকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি বহনক্ষমতা বাড়ানো, নদীর দুই পাড়ে বিদ্যমান বাঁধ মেরামত করা, দুই পাড়ে মোট ১০২ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ করা ইত্যাদি। নদীর দুই পাড় ঘিরে মহাপরিকল্পনা থাকছে পর্যটন নগরী। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা।
এখন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তা নদী পাড়ের মানুষ দুর্ভোগ হতে চিরমুক্ত হবে। তিস্তা হয়ে উঠবে আশীবাদ। লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কয়েক লাখ একর কৃষি জমি উদ্ধার হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই বছর ধরে তিস্তা নদী সার্ভে, পরিকল্পনা, ডিজাইনসহ সব প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন শুধু বাস্তবায়ন। তিস্তা নদীর বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। মানে রিভার ড্রাইভ রোড। গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট। দেড় শ’ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
রংপুর ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনায় অর্থায়নের ক্ষেত্রে যদি ভারত-চীন উভয় দেশের সরকার ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসে এবং প্রকৌশলগত বিদ্যা যদি এখানে সমন্বয় হয়, তাহলে উত্তর জনপদের কাছে উন্নয়নের নতুন মডেল সৃষ্টি হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ারুল হক ভূঁইয়া জানান, তিস্তা মহা পরিকল্পনা উত্তরাঞ্চলবাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে।
স্বাআলো/এস