সিন্ডিকেটের কবলে কোরবানির পশুর চামড়া, ক্ষতির মুখে মাদরাসাগুলো

মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: সারাদেশে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছে কাঁচা চামড়ার চাহিদা কম থাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন কোরবানির ঈদে পশু কোরবানির চামড়া সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান।

তারা বলছেন বেশি দিন নয় আজ থেকে ১০ বছর আগে কোরবানির চামড়া সংগ্রহ নিয়ে দলীয় ক্যাডারদের সাথে কওমী মাদরাসার শিক্ষকদের মারামারির শিরোনাম হতো। সময়ের ব্যবধানে কোনো দলীয় ক্যাডার বর্তমানে চামড়া সংগ্রহ করে না। সে সময় চামড়া কিনে মুনাফা হতো। এখন ফ্রি চামড়া সংগ্রহ করেও লাভ হচ্ছে না।

চুয়াডাঙ্গার পৌর এলাকার আছির উদ্দিন মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের সেক্রেটারি রাশিদুল ইসলাম বলেন, কোরবানির সম্পুর্ণ চামড়া মাটিতে পুতে না ফেলা পর্যন্ত কোরবানির চামড়ার দাম আর বৃদ্ধি পাবে না। আমরা শুধুমাত্র পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে থাকি।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এক সময় চামড়া কেউ সংগ্রহ করতে চাইবে না।

তিনি আরো বলেন, চামড়া আমাদের জাতীয় সম্পদ সেটা আমরা ধ্বংস করে ফেলছি। ২০১৩-১৪ সালে এক হাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার ১০০ টাকায় চামড়া কিনেও মুনাফা থাকতো। আজ চামড়া ফ্রি সংগ্রহ করেও মুনাফা থাকে না।

তিনি জানান, মাদরাসার ষ্টাফরা ৬৫টি গরুর চামড়া ও ২৯১টি ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে ছিলো। গরুর চামড়া ৫৫০ টাকা দরে ৩৫ হাজার ৭৫০ টাকায় ও ছাগলের চামড়া ৩০ টাকা দরে আট হাজার ৭৩০ হয়েছি।

তিনি আরো বলেন, চামড়া বিক্রি করে যে টাকা আসে, চামড়া সংগ্রহে ভ্যানভাড়াসহ শিক্ষক ছাত্রদের পারিশ্রমিক ধরলে মাদরাসায় কিছুই আসে না। চামড়ার দাম না পাওয়ায় সর্বোপরি আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। চামড়া একটি জাতীয় সম্পদ। তাই আমি বলতে চাই চামড়ার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, নীতি নির্ধারক তাদের কাছে অনুরোধ এই চামড়া শিল্পকে বাঁচান। যারা এই চামড়ার হকদার তাদের কাছে এই হক ফিরিয়ে দিন।

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর আলিম মাদরাসা ও কারিগরি এতিমখানা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, কোরবানিতে গরুর চামড়া ১২টি ও ছাগলের চামড়া ৮৭টি সংগ্রহ করেছিলাম। বছর শেষে চামড়ার মূল্য পাবো এই শর্তে আটটি চামড়া ৭০০ টাকা দরে, দুইটি ৩০০ টাকা দরে আর দুইটি রিজেক্ট করে দিয়েছে। ছাগলের চামড়া ৮৭টি ৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন বলে জানান।

তিনি জানান, এতিম শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা স্বাভাবিক রাখতে সঠিক মূল্যে চামড়া বিক্রির নিশ্চয়তা চান। এখনো গত বছরের চামড়ার দাম ৪০০ টাকা পাওনা আছে।

তিনি আরো জানান, চামড়ার দাম এমন থাকলে আর চামড়া সংগ্রহ করবেন না। চামড়া সংগ্রহ করতে ভ্যান ভাড়া লাগে এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা । এছাড়া ছুটির দিন ছেলেদের ভালো খাবার দিতে হয়।

তিনি আরো জানান, চামড়া সংগ্রহ করতে পোশাক নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু চামড়া সংগ্রহ করতে যে পরিমান খরচ হয় চামড়া বিক্রি করে তা আসে না। চামড়া বিক্রি করি। এ বছরও বিক্রি করেছি। সম্পর্ণ বাকীতে চামড়া বিক্রি করেছি। চামড়ার টাকা দুই /পাঁচ হাজার টাকা করে সারা বছর পরিশোধ করবে। এ টাকা একবারে পাওয়া যায় না। গরু ও ছাগলের প্রতি পাঁচটি চামড়ায় একটি চামড়া রিজেক্ট করেছে মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা। ছাগলের ৭০০টি চামড়ায় ১৪০টি ও গরুর ১৩০টি চামড়ায় ২০টি চামড়া বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি জানান, এখন পশুর চামড়া ফ্রি পেয়ে যে পরিমান টাকা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে জমা হয় তার চারগুণ টাকা জমা হতো ২০২৩-১৪ সালে পশুর চামড়া কিনে বিক্রি করে।

দামুড়হুদা দারুস সুন্না ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদরাসা ও চুয়াডাঙ্গা কোর্ট মসজিদের খতিব মুফতি রুহুল আমীন বলেন, আমার পরিচালনায় দামুড়হুদায় একটি প্রতিষ্ঠান আছে। ঐ প্রতিষ্ঠানে ২৫০ জন ছাত্র ও ২১ জন স্টাফ আছে। কোরবানিতে আমরা ৫৫টি গরুর চামড়া ও ৫৫০টি ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করেছি। আজ থেকে ১০ বছর আগে একটি গরুর চামড়া তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন সেই চামড়া বিক্রি করতে ভ্যান ভাড়া লাগে এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। এছাড়া ছুটির দিন ছেলেদের ভালো খাবার দিতে হয়।

তিনি আরো জানান, চামড়া সংগ্রহ করতে পোশাক নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু চামড়া সংগ্রহ করতে যে পরিমান খরচ হয় চামড়া বিক্রি করে তা আসে না।

আলমডাঙ্গার চামড়া ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কোরবানিতে ৩০ টাকা দরে ছাগলের চার হাজার চামড়া ও আকার ভেদে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দরে ৩০০ গরুর চামড়া কিনেছি। চামড়া লবণযুক্ত করতে লেবারসহ ২০০ টাকা খরচ হয়। একটি চামড়া ৯০০ টাকায় বিক্রয় হয় ও ছাগলের চামড়া ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। ঢাকায় হেমায়েতপুরে ট্যানারি মালিকদের কাছে আমার প্রায় ৪০ লাখ টাকা পড়ে আছে। আদায় করতে পারছি না।

চুয়াডাঙ্গা পৌরএলাকার নতুন বাজার এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী মহিন উদ্দীন মিয়া জানান, এ বছর কোরবানিতে ২০০ শত গরুর চামড়া ও এক হাজার ৩০০ ছাগলের চামড়া কিনেছি। কোয়ালিটি ভেদে গরু ৪০০টাকা থেকে ৮০০ টাকায় ও ছাগল ৩০ টাকা থেকে ৭০ টাকায় চামড়া কিনেছি। তিনি ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করেন না। ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনে যায় কিন্তু বাকী টাকা আর পরিশোধ করেন না।

তিনি জানান, চাপাইনবাবগঞ্জ,নাটোর ও কুষ্টিয়ায় চামড়া বিক্রি করেন।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিজ সম্পদ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা: আ.হ.ম.শামিমুজ্জামান জানান, এ বছর চুয়াডাঙ্গা জেলায় এক লাখ ৫৯ হাজার কোরবানির টার্গেট ছিলো এর মধ্যে এক লাখ ২০ হাজার কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে ছাগল বোক্রি ৯৯ হাজার ৩০০টি ও গরু ২০ হাজার ৭০০টি। চামড়ার মুল্য খামারিরা কাঙ্খিত মুল্য পায়নি। আমরা খামারিদের বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করে থাকি। কোরবানির চামড়া ঈদের দিনে বিক্রি না করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সহিত সংরক্ষণ করে ৩ দিন বা ৭ দিন পরে বিক্রি করলে ভালো মূল্য পাওয়া যায়।

এছাড়া তিনি জানান, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা বিজিবি, পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছি যেনো চামড়া চোরাই পথে পাশ্ববর্তী দেশে চলে না যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে।

বিসিক জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক এবিএম আনিসুজ্জামান বলেন, কোরবানির দিন আমদানির কারনে কাঁচা চামড়ার দাম কম থাকে। কোরবানির দিন অস্থায়ীভাবে পশুর চামড়া সংরক্ষণ করে তিনদিন থেকে সাতদিন পরে বিক্রি করলে দাম ভাল পাওয়া যায়। চুয়াডাঙ্গা এতিমখানাগুলো ঈদের দিন চামড়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে জেলার এতিমখানাগুলো প্রশাসন থেকে ১ টন লবন পেতে পারে যার বাজার মূল্য ১৭ হাজার টাকা।

তিনি আরো জানান, চামড়া সংরক্ষন না করার কারনে এই সহযোগিতা পাচ্ছে না চুয়াডাঙ্গার এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো।

সরকার নির্ধারিত মূল্যে চুয়াডাঙ্গার অড়ৎদারগুলো কোরবানির চামড়া না কেনার কারনে জেলার কওমী মাদরাসাগুলো ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে। চামড়া সংরক্ষণের জন্য বিসিক লবন সরবরাহ করলে এতিমখানা ও লিল্লাহ বোডিং গুলো চামড়া সংরক্ষণ করতে পারতো।

চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক ড: কিসিঞ্জার চাকমা জানান, আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যে এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং চামড়া সংরক্ষণ করছে তার তালিকা প্রস্তুত করার জন্য।

তিনি আরো জানান ,আমার জানা মতে আগ্রহী কোনো এতিমখানা তাদের চাহিদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে জমা দেন নাই।

জীবননগর হাসাদাহ আশরাফিয়া হাফেজিয়া লিল্লাহ বোর্ডিং ও মাদরাসার অধ্যক্ষ আক্তারুজ্জান ও চুয়াডাঙ্গা বেলগাছি আছির উদ্দিন হাফেজিয়া লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের সহ-সভাপতি ও চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার ৮ নং সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মনি বলেন, কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ করার জন্য যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে লবণ পাওয়া যায় এ তথ্য আমাদের জানা নেই।

তারা জানান, এই প্রথম জানতে পারলাম কোনবানির চামড়া সংরক্ষণে প্রশাসন থেকে লবণ পাওয়া যায়।

স্বাআলো/এস

Share post:

Subscribe

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

মোবাইল রিচার্জে ১০০ টাকার মধ্যে ৫৬ টাকাই ভ্যাট

ফের খরচ বাড়ছে মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে।...

শেখ হাসিনার ভিসার মেয়াদ বাড়ালো ভারত

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ...

সাতক্ষীরায় বিদ্যুৎপৃষ্টে কৃষকের মৃত্যু

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মুনছুর আলী...

আসছে হাড়কাঁপানো শীত, বাড়বে কুয়াশা

দেশজুড়ে আবারো হাড়কাঁপানো শীত আসছে। সেই সঙ্গে ঘন কুয়াশার...