আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে তীর্থযাত্রীদের উপর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর তীব্র আকার ধারণ করেছে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা। এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে নজিরবিহীন কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। অন্যদিকে, ভারতের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় জরুরি বৈঠক ডেকেছে পাকিস্তান, যা দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কা আরো ঘনীভূত করেছে।
বুধবার কাশ্মীরে হামলার ঘটনার পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে দেশটির নিরাপত্তা বিষয়ক সর্বোচ্চ কমিটি (ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিওরিটি – সিসিএস) বৈঠকে বসে। বৈঠকের পর জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানান।
তিনি বলেন, জম্মু-কাশ্মীরে সফল নির্বাচন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত করতেই সীমান্ত পার থেকে এই হামলা চালানো হয়েছে।
ভারতের নেয়া পদক্ষেপসমূহ:
সিন্ধু জলবন্টন চুক্তি স্থগিত: ১৯৬০ সালের এই চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করা হচ্ছে। পাকিস্তান যতদিন সীমান্তপারে সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া বিশ্বাসযোগ্যভাবে ও স্থায়ীভাবে বন্ধ না করবে, ততদিন এই স্থগিতাদেশ বলবৎ থাকবে।
আটারি সীমান্ত বন্ধ: পাঞ্জাবের আটারি সমন্বিত চেকপোস্ট অবিলম্বে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বৈধ ভিসাধারীদের পয়লা মের মধ্যে ফেরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিশেষ ভিসা বাতিল: সার্কের ‘বিনা ভিসা প্রকল্প’-এর আওতায় পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশের বিশেষ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। যাদের ইতোমধ্যে এই ভিসা দেওয়া হয়েছে, তাও বাতিল। এই ভিসায় বর্তমানে ভারতে থাকা পাকিস্তানিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে বলা হয়েছে।
পাকিস্তানি কূটনীতিক বহিষ্কার: দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিরক্ষা, সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর ‘পরামর্শদাতাদের’ ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ (অবাঞ্ছিত) ঘোষণা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতও ইসলামাবাদ থেকে সমতুল্য কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনবে এবং উভয় দূতাবাসে এই পদগুলো বিলুপ্ত করা হবে। এছাড়া উভয় দূতাবাসের পাঁচজন করে সামরিক কর্মীকেও দেশে ফিরতে হবে।
দূতাবাস কর্মী হ্রাস: পয়লা মে-র মধ্যে উভয় দেশের রাজধানীতে দূতাবাসের কর্মী সংখ্যা বর্তমান ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে আনতে হবে।
এই হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন, যা পাকিস্তান-ভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার শাখা বলে পরিচিত এবং এর পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মদত রয়েছে বলে মনে করা হয়।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ:
ভারতের এই কড়া পদক্ষেপের পর বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ দেশটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটির (এনএসসি) জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিতব্য এই বৈঠকে ভারতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে বলে জিও নিউজ জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। নয়াদিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ‘সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ’-এর পরিচালক তারা কার্থা ভারতের পদক্ষেপকে প্রায় ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ হিসেবে দেখছেন। তিনি সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের দেওয়া এক বিতর্কিত ভাষণের দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখানে মুনির দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন এবং কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘গলার শিরা’ আখ্যা দিয়ে কাশ্মীরিদের সংগ্রামে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকও গার্ডিয়ানকে বলেছেন, মুনিরের ওই বক্তব্যের এক সপ্তাহের মধ্যেই পেহেলগামের হামলাটি হলো।
মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয়েই কাশ্মীর হামলার জোরালো জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। সৌদি সফর সংক্ষিপ্ত করে মোদির দ্রুত দেশে ফেরা এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সহ উচ্চ-পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দলের ভারত সফরকালে এই ঘটনা ঘটা পরিস্থিতিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধিদল ভারতের সঙ্গে কৌশলগত ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এছাড়া, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও হামলার নিন্দা জানিয়ে ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।
সব মিলিয়ে, পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
(সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, গার্ডিয়ান)
স্বাআলো/এস