ঢাকা অফিস: তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের ধরনের পরিবর্তনের কারণে চলতি বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ঢাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা এরই মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এবার তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়ার ঝুঁকিতে আছে।
গত বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
এ সংখ্যা গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় দ্বিগুণ।
আবারো আসতে পারে শৈত্যপ্রবাহ, আবহাওয়া অধিদফতর
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে ১৫, ২০১৫ সালে রোগী শূন্য, ২০১৬ সালে ১৩, ২০১৭ সালে ৯২, ২০১৮ সালে ২৬, ২০১৯ সালে ৩৮, ২০২০ সালে ১৯৯, ২০২১ সালে ৩২, ২০২২ সালে ১২৬ ও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় এ বছর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দ্বিগুণ রোগী।
উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ব্রুটো ইনডেক্স বা বিআই ডিসেম্বরে-২০২৩ দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে বর্ষা-পরবর্তী এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি গত বছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ এ বছর ডেঙ্গুর ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে অসংক্রামক রোগ বাড়ছে। বাংলাদেশে গত ১০০ বছরের তাপমাত্রা যদি দেখেন তাহলে ২০২৩ সাল ছিলো উষ্ণ বছর। পৃথিবীর তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অসংক্রামক রোগ নীরব মহামারি হিসেবে কাজ করছে।
ডায়বেটিস, ক্যান্সার, কিডনি সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ রোগ অনেক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ডেঙ্গুও একটি কারণ। আমি মনে করি, আমাদের কীটতত্ত্ববিদদের কার্যক্রম বাড়ানো ও নাগরিকের ব্যক্তি সচেতনতা জরুরি।
শীত বিপর্যয়ের সাথে ডেঙ্গুর হানা
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুর চারটা ধরন। একজন মানুষ চারবার ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে থাকে।
দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগী খুবই মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়।
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, আমার ধারণা, ঢাকার বেশির ভাগ মানুষের ডেঙ্গু হয়েছে। সাধারণ উপসর্গ ও রোগ প্রতিরোধ থাকায় অনেকের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। তাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার ডেঙ্গু হলে মারাত্মক হবে। এমন পরিস্থিতি যেনো না হয়, এ জন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়ে কাজ করতে হবে।
পাঁচ জেলায় ৪০ শতাংশ রোগী স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ৩৪ শতাংশ ঢাকা মহানগরের এবং ঢাকার বাইরে ৬৬ শতাংশ। ঢাকার বাইরে পাঁচ জেলায় প্রায় ৪০ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বরগুনা ও নরসিংদী জেলায়। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪৫ বছর।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ঢাকার বাইরে ১৫ কোটি মানুষ বাস করে। গত বছর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ঢাকার বাইরে বেশি। এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
ডেঙ্গুজ্বরে একদিনে ৭ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৭৭
ডা. বেনজির আহমেদ আরো বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই। অভাব রয়েছে কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার এবং প্রশিক্ষিত লোকের। তাই এখন থেকেই কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার প্রশিক্ষণ দিয়ে কীটতত্ত্ববিদ বাড়ানো প্রয়োজন। মশা নিয়ন্ত্রণে একটি কারিগরি কমিটি, ওয়ার্ডভিত্তিক ডেঙ্গু জরিপ করতে হবে। ল্যাব বাড়াতে হবে।
মশা নিধন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের অভাব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, গত বছর তিন লাখ ২১ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এটি কেনো হলো এর একটি মূল্যায়ন থাকা দরকার ছিলো। যতো দিন ডেঙ্গুর সঙ্গে মশা মেলানো হবে, মশা এদেশ থেকে যাবে না, কারণ কিউলেক্স মশা আর ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সম্পূর্ণ আলাদা।
বর্ষা গেলেও ডেঙ্গু না কমায় উদ্বেগ
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. গোলাম সারোয়ার বলেন, মশক নিধনে আমাদের পরিকল্পনায় মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা, উড়ন্ত মশা মরছে কি না এ বিষয়ে মনিটরিং জরুরি। কারণ যে স্প্রে করা হচ্ছে, সেটা কতো দ্রুত যাচ্ছে, দূরত্ব ও ড্রপ সাইজ ঠিক আছে কি না জানা জরুরী। কারণ এতে মশা মরবে না বরং রেজিস্ট্যান্স হয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। হাসপাতালে ভর্তি ৮৯ ডেঙ্গু রোগী।
দেশে গত এক দিনে মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিনজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হলো এক হাজার ২০২ জন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
নতুন রোগীদের নিয়ে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছে ৮৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ৩৪ শতাংশ ঢাকা মহানগরের ও ঢাকার বাইরে ৬৬ শতাংশ। মৃতদের ৬০ শতাংশ ঢাকা ও ৪০ শতাংশ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।
স্বাআলো/এসআর/এস