জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত হোক বিচক্ষণ ও স্বচ্ছ

বাংলাদেশ বর্তমানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত বিষয়ে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে ১. মানবিক করিডোর ব্যবহারের অনুমতি, ২. চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের ব্যবহারের সুযোগ ও ৩. বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন কারখানা স্থাপনের সম্ভাব্যতা। এই বিষয়গুলো শুধু কূটনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক নয়, বরং দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তাই এ বিষয়ে যথাযথ বিশ্লেষণ এবং জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করে সিদ্ধান্ত নেয়া অতীব প্রয়োজন।
মানবিক করিডোর মানবতা না ভূরাজনীতি?
‘মানবিক করিডোর’ শব্দটি শুনতে মানবিক মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে কৌশলগত ও সামরিক বাস্তবতা। সাধারণত কোনো যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে আশ্রয় বা সাহায্য পৌঁছাতে এই করিডোর ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কেন এমন একটি করিডোর ব্যবহারের প্রস্তাব বিবেচনা করছে? কাদের জন্য এটি ব্যবহৃত হবে? এটি কি শুধুই মানবিক উদ্দেশ্যে, নাকি এর আড়ালে রয়েছে কোনো আঞ্চলিক শক্তির সামরিক কিংবা কৌশলগত উদ্দেশ্য?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-চীন দ্বন্দ্ব, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট, এবং বঙ্গোপসাগরে আন্তর্জাতিক আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা হতে পারে। করিডোর প্রতিষ্ঠিত হলে, সেখানে কারা প্রবেশ করবে, কারা তা তদারকি করবে ও কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির ভিত্তিতে তা পরিচালিত হবে এসব প্রশ্নের জবাব না দিলে তা ভবিষ্যতে আমাদের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর অর্থনৈতিক সুযোগ না নিরাপত্তা ঝুঁকি?
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার এবং অর্থনীতির চালিকাশক্তি। প্রতি বছর এই বন্দরের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম হয়। এমন একটি কৌশলগত স্থাপনা বিদেশী রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের সুযোগ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে—তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী?
এখানে শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরের উদাহরণটি বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। উন্নয়নের মুখোশে চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কা বন্দরটি নির্মাণ করে। কিন্তু সেটি লাভজনক না হওয়ায় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় এবং শেষমেশ ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। আজ সেই বন্দরে শ্রীলঙ্কার নয়, উড়ে চীনের পতাকা। এটি কেবল একটি বন্দর হারানোর গল্প নয়—এটি সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের অধিকার হারানোর নির্মম ইতিহাস। ঋণ নেওয়া দোষের নয়, তবে হিসাবহীন ঋণ ও কৌশলগত স্থাপনায় অপরিকল্পিত ছাড় এক সময় স্বাধীনতাকেই গিলে ফেলে। দেশ একবারে বিকোয় না—বিকোয় ধাপে ধাপে, সিদ্ধান্তে সিদ্ধান্তে।
এই বাস্তবতা মাথায় রেখে বাংলাদেশকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতির বিষয়টি চিন্তাভাবনা করতে হবে। শুধু বিনিয়োগ বা অবকাঠামো নয় ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ, তথ্যের নিরাপত্তা, এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
সামরিক কারখানা আত্মনির্ভরশীলতা না কৌশলগত আশ্রয়?
দেশে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়, যদি তা দেশকে প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর করে তোলে। তবে প্রযুক্তির মালিকানা, উৎপাদিত অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের ঝুঁকি ভালোভাবে বিশ্লেষণ না করলে এই ধরনের কারখানাই পরিণত হতে পারে ভবিষ্যৎ হুমকির কেন্দ্রে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ কোনো নির্দিষ্ট পক্ষের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
স্বচ্ছতা ও জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি
উল্লিখিত তিনটি বিষয়েই এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে স্পষ্ট কোনো নীতিমালা বা জনগণকে জানানোর মতো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। জাতীয় নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বার্থে কিছু বিষয় গোপন রাখা যায় তবে একেবারেই জনঅন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নেয়া গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী।
জনগণের অর্থ, জমি, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এই সিদ্ধান্তগুলো অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে খোলামেলা আলোচনার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করা উচিত। সংসদ, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ সবার মতামত ও বিশ্লেষণ নিলেই এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর, গ্রহণযোগ্য এবং নিরাপদ হবে।
বাংলাদেশ আজ এক জটিল ভৌগোলিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ভুল সিদ্ধান্তের পরিণতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বহন করতে হতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত হোক বিচক্ষণ, জনভিত্তিক ও স্বচ্ছ। আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব কোনো দেশের কাছে ধার করে রাখা যায় না তা রক্ষা করতে হয় দৃঢ়তা, সচেতনতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে।
স্বাআলো/এস