বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প উৎপাদন ও খুচরা বিক্রির প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে শ্লথ হয়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঋণ সংকট, এবং ক্রয়ক্ষমতার ক্রমাগত হ্রাস এই মন্দার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী সংগঠন এবং অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ থেকে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মে ২০২৫ অর্থনৈতিক পর্যালোচনা অনুযায়ী সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.০৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক, মে ২০২৫)। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯.৫৮ শতাংশ এবং অ-খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮.৪৯ শতাংশ। ফলে সাধারণ মানুষের হাতে ব্যয় করার মতো অর্থ থাকছে না।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, “তিন বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ ভোক্তা চাহিদা দুর্বল। মূল কারণ দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খরচ করছে, অথচ নতুন আয়ের উৎস বাড়ছে না। এই বাস্তবতায় বিনিয়োগও থমকে গেছে।”
রাজধানীর গাউছিয়া, নিউ মার্কেট ও বসুন্ধরা সিটির ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এবারের দুই ঈদেই পোশাক বিক্রি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির নেতা খোরশেদ আলম বলেন, “গত বছরের চেয়ে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার কম পোশাক বিক্রি হয়েছে। মানুষ পোশাক কিনলেও সীমিত পরিমাণে কিনছে।”
খুচরা বাজারের মন্দা খাবার, পানীয়, সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স ও আসবাবপত্র পর্যন্ত সব খাতে প্রভাব ফেলেছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “মানুষ এখন বড় পণ্য কিনছে না। পাঁচ লিটারের তেলের বদলে দুই লিটারের বোতল নিচ্ছে, বড় পাউরুটির বদলে ছোটটা নিচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ কষ্টে আছে।”
নির্মাণ খাতেও স্থবিরতা প্রকট। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে রডের চাহিদা কমে গেছে। আমাদের উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছে।”
রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারে বিক্রি ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বারভিডার সভাপতি আবদুল হক বলেন, “অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ডলার সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গাড়ি বিক্রি কমে গেছে। মানুষ এখন কম দামের গাড়ি খুঁজছে।”
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোরবানির পশুর বাজারেও ধস নামে। এ বছর ৯১ লাখ পশু বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ১৫ লাখ কম । যশোরের খামারি আবদুল গফুর বলেন, “বড় গরুর চাহিদা একেবারে কমে গেছে। ঋণ নিয়ে পশু পালন করেছি, এখন বিক্রি না হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছি।”
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতির কারণে ৫ আগস্টের পর রেস্তোরাঁ ব্যবসা অন্তত ৩০% কমেছে। অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।”
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৪.১৩% । এতে নতুন ঋণ বিতরণ কমে গেছে, যার ফলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
এমসিসিআই এবং পলিসি এক্সচেঞ্জের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “মে মাসে পারচেজিং ম্যানেজার ইনডেক্স ৮.৮ পয়েন্ট কমে ৫২.৯ হয়েছে, যা গত অক্টোবরের পর সর্বনিম্ন। নতুন ব্যবসা সূচক ও কর্মসংস্থান সূচকও সংকোচনের দিকে গেছে।”
অর্থনীতিবিদ ড. সৈয়দ সামসুল আলম বলেন, “এই মন্দা অস্থায়ী নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগে আস্থা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ ছাড়া অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না।”