জাতীয়

সংকটে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা

ঢাকা অফিস | June 27, 2025

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের একপর্যায়ে পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দেয় ইরান। বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহ চেইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথ বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি তেলের বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি হবে, যা ইতোমধ্যে আশঙ্কার ছায়া ফেলেছে বাংলাদেশসহ আমদানিনির্ভর দেশগুলোর ওপর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা এমন এক সময়েই ঝুঁকির মুখে পড়েছে, যখন দেশের তেল মজুত সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে বহু নিচে অবস্থান করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সর্বোচ্চ যে মজুত রাখতে পারে, তাতে সাকুল্যে দুই মাস চলার মতো জ্বালানি সঞ্চিত থাকে। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অন্তত ৯০ দিনের মজুত থাকা উচিত।

মজুতের ভয়াবহ চিত্র

বিপিসির ২৩ জুনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডিজেল মজুত আছে ২৭ দিনের, অকটেন ৭ দিনের, পেট্রোল ৮ দিনের এবং ফার্নেস ও জেট ফুয়েল আছে ২৮ দিনের। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ৬৭ লাখ ৬১ হাজার টন জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬৩ শতাংশই ডিজেল (৪২ লাখ ৫৪ হাজার টন)। অথচ ডিজেলের মজুত সক্ষমতা বিগত পাঁচ বছরে উল্টো কমেছে প্রায় ২৪ হাজার টন।

বর্তমানে বিপিসির কার্যকর ডিজেল মজুত ৬ লাখ ৫৩ হাজার টন, যা চলতি বিক্রির হারে ৫৮ দিনের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট। একইভাবে অকটেনের কার্যকর মজুত মাত্র ৫০ হাজার টন, যা চলবে ৩৮ দিন।

কেন বাড়ছে না মজুত?

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, “সরকারি মজুত বাড়ানোর প্রতি সরকারের আন্তরিকতা নেই। কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে বেসরকারি ট্যাংক ফার্ম ভাড়া নিতে চান। এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে, বাড়ছে ঝুঁকি।”

তার অভিযোগ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ডিপোগুলোতে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নতুন ট্যাংক বসানোর সুযোগ না থাকলেও নতুন জায়গা কিনে মজুত বাড়ানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বরং সংকট তৈরি হলে তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ভাড়ায় ট্যাংক নিতে হয়, যার জন্য সরকারকে লিটারপ্রতি অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয়।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিপিসি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, “বিপিসি পরিচালনা করেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই জ্বালানি খাতের বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। একজন কর্মকর্তা দায়িত্ব বুঝে উঠতেই বদলি হয়ে যান। এতে পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা থাকে না।”

তাঁর মতে, কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হলে জ্বালানি ও বিপিসি বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে একটি বিশেষায়িত টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মণি লাল দাশ জানান, নতুন করে ট্যাংক ফার্ম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় পদ্মা অয়েলে দুটি, যমুনা ও মেঘনায় দুটি করে নতুন ট্যাংক নির্মাণের টেন্ডার হয়েছে। এতে প্রায় ৮০ হাজার টন বাড়তি স্টোরেজ সক্ষমতা তৈরি হবে।

বর্তমানে বিপিসির মোট স্টোরেজ সক্ষমতা প্রায় ১৫ লাখ ৮৪ হাজার টন, যার মধ্যে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন সাম্প্রতিক প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। তবুও এটি বর্তমান চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।

সংকটে নীতিনির্ধারণের বাস্তবতা

জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কৌশলগত মজুতের বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক উত্তেজনা, যেমন হরমুজ প্রণালির অচলাবস্থা, বাংলাদেশের আমদানির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ বাংলাদেশের জ্বালানির বড় একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে।

অথচ এমন সম্ভাব্য বিপদের জন্য দেশের প্রস্তুতি রয়ে গেছে সীমিত পরিসরে। সাশ্রয়ী ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে নিজস্ব মজুত ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং তেল পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

Shadhin Alo