দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পর দলে ব্যাপক ভাঙনের যে আশঙ্কা করেছিলো বিএনপি, তা থেকে মোটামুটি রক্ষা পেলেও ভাঙনের সুর কিছুটা হলেও শুনতে হলো দলটিকে। বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন মধ্যম সারির নেতা, সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং মাঠ পর্যায়ের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন (বিএনএম), কেউ তৃণমূল বিএনপি আবার কেউ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এমনকি একজন আওয়ামী লীগ থেকেও নির্বাচন করছেন।
কেবল পদে থাকা নেতারা নন, বিভিন্ন কারণে নিকট অতীতে বিএনপি থেকে বহিষ্কার, পদচ্যুত অথবা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা নেতারাও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এসব নেতা দল ছাড়লেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সভা-সমাবেশ, টেলিভিশন টক শো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্র-পত্রিকা অথবা ব্যক্তিগত পেজ-ব্লগে কনটেন্ট তৈরি, বক্তৃতা-বিবৃতি বা লেখনির মাধ্যমে সরকারবিরোধী অবস্থান ধরে রেখেছিলেন তারা।
কিন্তু ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতির অমোঘ টান উপেক্ষা করতে পারেননি তারা। তাই দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির এসব নেতা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৭ জানুয়ারি নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন তারা। এদের মধ্যে একজন আবার নৌকা প্রতীকেই লড়বেন।
মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিনে এসে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন তিনি। তাকে নৌকা প্রতীকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ আসন থেকে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বিএনপি থেকে বেরিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে দলটির নির্বাহী সদস্য শাহ আবু জাফর। এই মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তার নির্বাচনি আসন ফরিদপুর-১।
এ আসন থেকে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির এবং ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবু জাফর। এবার তিনি নোঙ্গর প্রতীকে লড়বেন।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তার নির্বাচনি আসন ব্রহ্মণবাড়িয়া-১। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলে বড় কোনো পদ না থাকলেও বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়ার রাজনীতিতে পরিচিত মুখ সাবেক চার বারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তার নির্বাচনি আসন বগুড়া-৪। এ আসন থেকে ১৯৯৪ (উপনির্বাচন), ১৯৯৬ (১৫ ফ্রেব্রুয়ারি), ১৯৯৬ (জুন) এবং ২০০১ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন।
গাজীপুর মহানগর বিএনপির নেতা ও বাসন থানা বিএনপির সহসভাপতি জব্বার সরকার, সাবেক ছাত্রনেতা ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি মোজাফফর আহমেদ ও জাতীয়তবাদী আইনজীবী ফোরামের সহসভাপতি আব্দুল কাদির তালুকদার তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন।
গাজীপুর- ১ আসনে জব্বার সরকার, ঠাকুরগাঁও- ২ আসনে মোজাফ্ফর আহমেদ এবং চাঁদপুর- ৪ থেকে আব্দুল কাদের তালুকদার পাটের আঁশ প্রতীকে লড়বেন।
এ ছাড়া সরকার বাদল বগুড়া-৭ আসনে, দেলয়ার হোসেন খান দুল ময়মনসিংহ-৪ আসনে, ডা. আসমা শহীদ ফরিদপুর-২ আসনে, সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিক নীলফামারী-৪ আসনে, মাওলানা মতিন চাপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে, বিউটি বেগম বগুড়া-২ আসনে, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ঝালকাঠি-২ আসনে, শাহ শহীদ সারোয়ার ময়মনসিংহ-২ আসনে এবং শুকরান বগুড়া-১ আসনে আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব (টাঙ্গাইল-৫) এবং দেলদুয়ার উপজেলা বিএনপির সদস্য খন্দকার ওয়াহিদ মুরাদ (টাঙ্গাইল-৬) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
বিএনপি থেকে ছিটকে পড়া বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাও এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এদের মধ্যে মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান (কিশোরগঞ্জ-২) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন। এ আসনে ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ নির্বাচন করবেন কুমিল্লা-৫ আসন থেকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন ইউনুস। সে বছর মনোনয়ন চেয়েও পাননি শওকত মাহমুদ।
বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এই মুহূর্তে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন। তিনি সিলেট-৫ আসনে নির্বাচন করবেন। আর তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচন করবেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে।
এর বাইরেও আরো কয়েকজন বিএনপি নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে দলে তাদের প্রভাব ও পদ-পদবী তেমন না থাকায় তারা আলোচনায় আসছেন না।
দলের নেতাদের প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এটাকে আমরা খুব বড় ঘটনা হিসেবে দেখছি না। এত বড় দল থেকে দুই চারজন বেরিয়ে গেলে তেমন কিছু হয় না। তাদের ছাড়াই দল ভালো মতো চলবে।
স্বাআলো/এসএ