নোয়াখালীতে এখনো পানিবন্দি ১২ লাখ মানুষ

জেলা প্রতিনিধি, নোয়াখালী: জেলার বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা গত ৫০-৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। সরকারি হিসেব বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীতে।

যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চার হাজার ১৯১ কোটি টাকা। বন্যা পরবর্তীতে দীর্ঘ হয়েছে জেলার জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি। আর এর জন্য খাল দখল, খালের ওপর বহুতল ভবন, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র কালভার্ট, বাঁধ নির্মাণকে দাবি করে দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

দেখা গেছে, জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও পানি রয়েছে প্রতিটি বাড়ির উঠোনে। কোথাও হাঁটু পরিমাণ, কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি রয়েছে।

জানা যায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে ফেনী থেকে নেমে আসা পানি উজানের প্রবেশ করায় নোয়াখালীর আটটি উপজেলা প্লাবিত হয়। এরই মধ্যে টানা ভারি বৃষ্টিতে প্রতিটি বাড়ির উঠোন ও সড়ক ৮/৯ ফুট পানির নিচে প্লাবিত হয়। নিজেরদের বসত ঘর ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বহুতল ভবনের বাসা ও পাশ্ববর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেন বন্যা কবলিত মানুষজন। এখনও অনেকে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে রয়েছেন। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছিলো জেলার সদর, কবিরহাট, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলা। কিন্তু বন্যার দীর্ঘ দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখনও পানি বন্দি হয়ে আছে চৌমুহনী পৌরসভার বেশির ভাগ ওয়ার্ড। বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো বেশির ভাগ বাড়ির উঠোনো হাঁটু পরিমান পানি রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা সবুজ জানান, প্রায় ২মাস আগে তিনি বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যান। কয়েকদিন আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে যাওয়ার কারনে আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে তাদের চলে আসতে হয়। এরপর থেকে চৌমুহনী বাজারের ছোট একটি বাসায় তারা ভাড়া নিয়েছেন। এখনও পরিবারের সবাই ওই বাসায় আছে। কবে নাগাদ পানি নামবে, আর কবে বাড়ি আসতে পারবেন তা নিশ্চিত নয় তিনি।

স্থানীয়রা বলছেন, শুধু চৌমুহনী পৌরসভা নয় একই চিত্র জেলার সদর উপজেলার নেয়াজপুর, চরমটুয়া, কাদির হানিফ ইউনিয়ন, কবিরহাট উপজেলার নরোত্তমপুর, সুন্দলপুর ইউনিয়ন, সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া, কেশারপাড়, ডমুরুয়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামের। এছাড়াও বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার সবকয়টি ইউনিয়নে এখনও জলাবদ্ধতা রয়েছে। আর এই জলাবদ্ধতা দীর্ঘ হওয়ায় বেড়েছে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ।

ভুক্তভোগী একাধিক ব্যক্তি বলেন, গত ১৬ বছর প্রভাবশালী মহল তাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে জেলার অধিকাংশ বড় খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। দোকান ঘর করে ভাড়া দিয়েছে অনেক স্থানে। সংযোগ খালগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। পরিকল্পিত ভাবে এ খালগুলোর মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে কালভার্ট, বাড়ির দরজার করা জন্য দেওয়া হয়েছে বাঁধ। খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় বন্ধ হয়েছে পানির গতিপথ। যার ফলে দীর্ঘ দুই মাসেও বন্যা কবলিত এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে যেতে পারছে না। এছাড়াও সবগুলো খালে অবৈধভাবে বসানো হয়েছে ভেসালজাল। যার কারনে বেশি গতিতে নামতে পারছেনা পানি।

স্থানীয়রা বলছেন, নোয়াখালীর ভাটি এলাকা লক্ষীপুর জেলা। নোয়াখালীর পানি লক্ষীপুর হয়ে মেঘনা নদীতে পড়ে। তাই, নোয়াখালীর জলাবদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে লক্ষীপুর জেলার খালের উপর সকল বাঁধ, অবৈধ স্থাপনা, ভেসাল জালসহ পানি নামার জন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো সরানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নোয়াখালী ও লক্ষীপুর প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করা দরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নোয়াখালী খালের সদর উপজেলার বিভিন্ন অংশ, শহরের ওপর ছাগলমারা খাল, চাটখিলের খিলপাড়া, রামনারায়ণপুর, বদলকোট, নোয়খলা, সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া, কেশারপাড়, সোনাইমুড়ী উপজেলার বগাদিয়া উত্তর পোল থেকে কালিকাপুর পর্যন্ত, কলেজ গেইট থেকে নান্দিয়া পাড়া পর্যন্ত, বজরা থেকে চাঁদুপুর পর্যন্ত খাল দখল হয়ে আছে। বেগমগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক স্থাপনা রয়েছে। চৌমুহনী বাজারে খালের সিংহভাগ অংশ ব্যবসায়িরা ময়লা আর্বজনা ফেলে ভরাট করেছে। এছাড়া কবিরহাট উপজেলার রিকশা ওয়ালার দোকান এলাকায় খালের মাঝখানে দেওয়া হয়েছে একাধিক বাঁধ। দখল করা হয়েছে ওয়াপদা খালের বেশির ভাগ অংশ। আর এ খাল দখল ও বাঁধই হয়েছে জেলার মানুষের গলারকাটা।

চৌমুহনী বাজারের ব্যবসায়ী সোহান বলেন, বাজারের প্রধান সড়ক ছাড়া বাকি সবকয়টি এলাকা অনেক নিচু। বন্যার পর কয়েক বার পানি নেমেছিলো, আবার বৃষ্টিতে পানি জমতে থাকে। একদিন বৃষ্টি হলে ৩/৪দিন পানি জমে থাকে। চৌমুহনী বাজারের বড় খালগুলোতে ময়লা ফেলে ভরাট করা হয়েছে। আশপাশের সবগুলো ছোট খাল দখল করে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ও বাড়ির সামনে বাঁধ দিয়ে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে প্রতিটি জায়গায় পানি আটকে আছে। এ বাঁধগুলো না থাকলে হইতো পানি সরসরি বড় খালে চলো আসতো। বড় খাল সংস্কার করার পাশাপাশি ছোট খালগুলোর দখলকৃত স্থান গুলো উদ্ধার করা না হলে এ পানি সহজে নামবে না।

জেলা শহর মাইজদীর আরিফুল ইসলাম নামের এক বাসিন্দা বলেন, শহরে জলাবদ্ধতার কারণ অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। তাঁর মতে শহরে যেভাবে ড্রেন করার কথা ছিলো সেটি সেভাবে না করে ড্রেনের জায়গায় কোনভাবে নালা করা হয়েছে। ফলে এ টুকু জায়গা দিয়ে পানি নামছে না, তারোপর ড্রেনে ময়লা ফেলে পানির গতিপথ বন্ধ করা হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। আজ প্রায় ৩মাসের বেশি সময় ধরে শহরে জলাবদ্ধতা লেগেই আছে। কবে এটি থেকে মানুষ মুক্তি পাবে এটি কারও জানা নেই।

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা প্রশাসকের রাজস্ব বিভাগের কাগজে-কলমে অনেক খালের হিসাব থাকলেও বাস্তবে তা নেই। কয়েক বছর ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাবশালীরা খালগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়েছেন, নিজেরাও দখলে নিয়েছেন অনেকাংশ। অথচ; একসময় জেলার বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনী থেকে এসব খাল হয়ে পণ্যবাহী নৌকা জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং পাশের লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও চাঁদপুরে যেতো। বর্তমানে নৌকাতো দূরের কথা এসব খাল দিয়ে পানি নামতে পারছে না।

জেলা প্রশাসকের সবশেষ তথ্যমতে, জেলায় বন্যা এখনো পানি বন্দি ১১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। খোলা রয়েছে ২৮টি আশ্রয় কেন্দ্র, যেখানে এখনো রয়েছেন প্রায় ৭শতাধিক মানুষ।

জেলা প্রশাসক খন্দতার ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, বন্যা পরবর্তী সময় বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক স্থান থেকে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় খালের ওপর থাকা কিছু স্থাপনা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পানি প্রবাহ সচল করতে খাল পরিষ্কারের কাজও করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে খাল দখল করে যেসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভেঙে দেয়াসহ খাল পুনঃসংস্কারের ব্যবস্থা পরিকল্পনায় রয়েছে।

স্বাআলো/এস

Share post:

Subscribe

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

টোলপ্লাজায় নিহত ৬: সেই বাস চালক গ্রেফতার

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় বেপরোয়া গতির বাসের ধাক্কায়...

পটুয়াখালীতে বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা

জেলা প্রতিনিধি, পটুয়াখালী: মহান ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে...

কেউ যেনো মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে না পারে: জামায়াতে আমির

ছাত্রদের স্যালুট জানানোর ইচ্ছা পোষণ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর...

নড়াইলে ইউপি সদস্যকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর মুখে বিষ ঢেলে হত্যা

নড়াইলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নারী (৫০) ইউপি সদস্যের মৃত্যু...