নির্বাচনী পরীক্ষা চলাকালে যে ছাত্রটি তার শিক্ষকের গালে পরপর কয়েকটি চড় মারলো- এই চড়টি কি ঐ শিক্ষক খেলেন?
‘আজ হতে চীর উন্নত হলো শিক্ষা গুরুর শীর, সত্যি তিনি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর’ অতীতের সেই শ্রদ্ধার্হ বাদশাহ কি বুঝলেন, কে চড়টি খেলেন? একজন ছাত্র, যে দশম শ্রেণিতে পড়ে। সরকারি স্কুলে। এমন একজন ছাত্রের মানসিকতা, মানবিকতা, মননশীলতা শুভ্র, সুন্দর ও নমনীয় হবে। এটাই স্বাভাবিক। অথচ ছাত্রটি কত স্বাভাবিকভাবে সামনে এগিয়ে গেলো। তার শিক্ষকের সাথে বিতণ্ডা করলো এবং খুবই স্বাভাবিকভাবে পরপর কয়েকটি চড় মারলো। দৃশ্যটি খুবই অস্বাভাবিক, আমানবিক, অসুন্দর ও পীড়াদায়ক। এ থেকেই আমাদের বুঝে নিতে হবে আমরা কোথায় আছি। আমাদের সামাজিক অবস্থান কেমন। একজন ছাত্র কিভাবে তার শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে পারে? এটা সে কিভাবে পারলো। তাকে কি প্রতিষ্ঠানে আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি। তার পরিবার কি তার এই ব্যবহারে সমর্থন যুগিয়েছে। তার বন্ধু বান্ধব, তার পরিমন্ডল কি তাকে এই কাজে উৎসাহ যুগিয়েছে।
সরকারি জিলা স্কুলের এই ছাত্র আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষাঙ্গণের স্বাভাবিক অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছে। তার আচরণ কে আমরা মাধ্যমিক শিক্ষাঙ্গণের চলমান অবস্থার বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নিতে পারি। মাধ্যমিক পর্যায়ে শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ হয়েছে। এমন কি তিরস্কারও করা
যাবেনা। সিদ্ধান্ত টি ভালো। তবে এর জন্য পরিশীলিত পরিবেশ দরকার ছিলো। পরিশীলিত পরিবার দরকার ছিলো। দরকার ছিলো শুভ্র মনন, সৎ নৈতিক চেতনা এবং সহমর্মিতা ও সহযোগিতার এবং সামাজিক ঐতিহ্যের। আমরা কি তা পাচ্ছি? পাচ্ছি না। ঐ ছাত্রটি তো দশম শ্রেণিতে পড়ে।
জেলা স্কুলে এমন একজন ছাত্র কিভাবে এই আচরণটি করলো। সে কিভাবে এটা করার সাহস পেলো। তার মানসিকতায় এটা কিভাবে এলো। সে তো অন্যের খাতা দেখার চেষ্টা করছে। এটা তো অপরাধ। একজন অপরাধী লজ্জিত হবে, ভীত হবে, বিনীত হবে। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে সে উদ্ধত হলো। মাফ চাওয়ার পরিবর্তে সে মারমুখী হলো। আমরা কলঙ্কিত হলাম। এখানে কিছু বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। ঐ শিক্ষার্থীর এই অবস্থার জন্য আমরা দায়ী। আমরা যারা সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছি, যারা সমাজ ব্যবস্থার শীর্ষে বসে আছি, তারা ঐ শিক্ষার্থীর মেধা মননে চেতনায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারিনি। যেটা এনেছি, তা হলো নেতিবাচক পরিবর্তন। যা সমাজের জন্য হিতকর নয়। ঐ ছাত্রটির এই ব্যবহারের পিছনে তার পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গণ ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব রয়েছে। সে দেখেছে সমাজে যারা খারাপ কাজ করছে, তারা ধরা ছোয়ার বাইরে। তাদের অনেক ক্ষমতা। সমাজে তারা বড় ভাই। নেতিবাচক হলেও তাদের দাপট রয়েছে। কেউ তাদের কিছু বলতে পারেনা। বললেও কাজ হয় না। যদি কখনো রিস্ক নিয়ে কেউ বড় পদক্ষেপ নেয়, সেখানে তাদের আটকে রাখতে পারে না। তারা অচিরেই ফিরে আসে। আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারাই বড় বড় গাড়ি চড়ে। তারা নেতৃত্ব দেয়। তারাই সমাজের বিচার করে। এগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করে। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার পিছনে এগুলো অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে।
সে আরো দেখেছে, চাকরি না দিলে, কাজ না দিলে, অকাজে বাঁধা দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। শেষমেশ উপাচার্য মহোদয়কে নমনীয় হতে হচ্ছে। সে দেখেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষার্থী বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে যা করছে, তারা না পড়েই প্রতিষ্ঠান থেকে এই সুবিধাগুলো নিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে সক্ষম নয়। এই অবস্থাগুলো নেতিবাচক এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ক্ষতিকর হলেও এগুলো প্রতিষ্ঠিত। এখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ আমরা দেখছি না। তার এই অবস্থার জন্য পারিবারিক রুচি, আভিজাত্য ও বংশ কৌলিন্যও দায়ী। পরিবার তাকে পরিশিলীত করতে পারিনি। তাকে মানুষের সম্মান, শ্রদ্ধা বিষয়ে সচেতন করতে পারিনি। সাথে সাথে আমরা শিক্ষকরাও একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা নই। আমরা সামান্য পদ, সম্মান ও অর্থের জন্য নিজেকে বিক্রি করে দিচ্ছি। তেল মারতে মারতে তৈলবীদ হয়ে যাচ্ছি। আমি যে একজন শিক্ষক, সাধারণ মানুষের থেকে আমি আলাদা, এটা ভুলে যাচ্ছি।
একজন শিক্ষক যদি তোষামোদি করেন, মোসাহেবি করেন, সমাজ কেনো তাকে শ্রদ্ধা করবে? সাথে সাথে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আমরা যারা শিক্ষকতায় এসেছি বা আসছি তাদের তো কোনো দায়ভার নেই। টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন, মানুষ গড়ার দায়বদ্ধতা তো তার নেই। তার কাছে আমরা এটা আশাও করতে পারিনা।
শিক্ষক মানুষ গড়বে। তাকে তো সেই পরিবেশ দিতে হবে। ১২ হাজার ৫০০ টাকার স্কেলে একজন মাস্টার্স পাশ করা নিবন্ধিত মানুষকে আপনি শিক্ষকতা পেশায় আনছেন। এই টাকায় তার সংসার চলবে? তাকে তো প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং করানো ইত্যাদির চিন্তা করতে হবে।
সে মানুষ গড়ার সময় পাবে কোথায়? কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক। তাহলে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষকের জন্যও তো কিছু কাঙ্ক্ষিত থাকতে পারে— সেটা কি নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু স্লোগানে সব হয়ে যাবে? শিক্ষককে কাঙ্ক্ষিত বেতন দিতে হবে। তবেই শিক্ষকের সম্মান বাড়বে। শিক্ষক সম্মানিত হলে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা অটো আসবে। এটা সদাশয় সরকার বাহাদুর কে করতে হবে। পাশ্চাত্যের শিক্ষা পদ্ধতি আনবেন অথচ পাশ্চাত্যের মত সম্মানি দেবেন না। এটা কি হয়!
সামাজিক, আর্থিক এই পরিবর্তন সদাশয় সরকার বাহাদুরকে করতে হবে। শিক্ষকের ঐ বেতনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া আছে এক হাজার টাকা। একজন শিক্ষক যিনি মানুষ গড়ার কারিগর তাকে আমরা এক হাজার টাকার বাড়িতে রাখছি। ঐ বাড়িতে আমার শিক্ষক থাকতে পারবেন?
শিক্ষকের সম্মানি বৃদ্ধি না করলে আপনি যে বাড়িতে শিক্ষককে থাকতে দিচ্ছেন আমাদের সমাজ ঐ শিক্ষককে ঐ বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এবং শিক্ষককে চড় মারা ঐ শিক্ষার্থী অচিরেই নেতা হয়ে যাবে। বড় কোনো পদ পাবে। সামাজিক নেতৃত্ব দেবে। আর আমাদের মত শিক্ষককে তার স্বাক্ষর নেয়ার জন্য তার বাসার নীচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
লিখেছেন: খায়রুল আনাম
অধ্যক্ষ
এম এস টি পি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, যশোর।