রংপুর বিভাগ

চরের শিশুরা যেনো জন্ম থেকেই প্রশিক্ষিত শ্রমিক!

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট | June 3, 2025

লালমনিরহাটের নদীঘেরা চরাঞ্চলগুলোতে দারিদ্র্য এক কঠিন বাস্তবতা। এখানকার শিশুদের কাছে খেলাধুলা, পড়ালেখা কিংবা বিনোদন নয়, বরং দুই মুঠো ভাতের সংস্থানই প্রতিদিনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ছুটে যায় ফসলের খেত বা কৃষকের সন্ধানে, শ্রমের বিনিময়ে একবেলার আহার জুটিয়ে নিতে।

এই চরের শিশুরা যেনো জন্ম থেকেই প্রশিক্ষিত শ্রমিক। তারা জানে কেমন করে জমিতে মই দিতে হয়, আলু গাছের গোড়ায় মাটি তুলতে হয় কিংবা ধান কাটতে হয়। ছোট থেকেই তারা এসব কাজ শিখে নেয়। মাটির সঙ্গেই এদের বেড়ে ওঠা, আর মাটির গন্ধেই যেন তারা খুঁজে পায় জীবনের মানে।

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার শৌলমারীর কৃষক আবেদ আলী বলেন, সকাল হলেই ছোটরা দৌড়ে চলে যায় ক্ষেতে। অনেকেই বাবার সঙ্গে হাল চাষে, কেউ সেচ দেয়, কেউ আবার ধান তোলে।

চরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিশুই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও দারিদ্র্যের কারণে খুব কম জনই মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারে। স্কুলের ঘণ্টার আগেই তাদের হাতে উঠে আসে কোদাল, কিংবা গরুর দড়ি।

হাতীবান্ধার উপজেলার ডাউয়াবাড়ী চরের কৃষক আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, আমার ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে, কিন্তু এখন কাজ না করলে আমাদের ভাত জুটবে না। মেয়েরা অনেক সময় কাজের ফাঁকে ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করে, রান্না করে বা মাঠে মা-বাবাকে সহযোগিতা করে। স্কুলের ব্যাগ আর কৃষিকাজের কোদালের ভার একসাথে বহন করা সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষে, ফলে অধিকাংশই ঝরে পড়ে শিক্ষা জীবন থেকে।

তিস্তায় পানি বৃদ্ধি: তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, বন্যা আতঙ্ক

তবে দিনের শেষে বালুমাটিতে ১০-১২ জন কিশোরকে দলবদ্ধভাবে খেলতে দেখা যায়। হয়তো কারো পায়ে স্যান্ডেল নেই, গায়ে ঠিকঠাক জামা নেই, কিন্তু তাদের চোখেমুখে থাকে এক অদম্য তেজ। তারা ফুটবল, ক্রিকেট খেলে, যেন ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায় জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট। নেই কোনো প্রশিক্ষক বা মানসম্পন্ন সরঞ্জাম, তবুও তারা খেলে, নিজেদের মতো করে।

একই চরের বাসিন্দা মকবুল হোসেন জানান, আমাদের চর থেকে কয়েকজন ছেলেপেলে এখন জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলে। তাদের পেট খালি থাকুক বা গায়ে ছেঁড়া জামা, পায়ে ফাটা থাকলেও মুখে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস লক্ষণীয়। চরাঞ্চলের শিশুদের জীবন যেনো রাষ্ট্র এবং সমাজের কাছে এক মৌন প্রতিবাদ।

১৫ বছরের রাজু ইসলাম, যে সকালে স্কুল শেষে বিকেলে মাঠে কাজ করে, তার কথায় ফুটে ওঠে বাস্তবতা, আমরা জানি কীভাবে চাষ করতে হয়, কীভাবে মাঠে কাজ করতে হয়, কিন্তু জানি না কীভাবে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হয়। এই শিশুরা কেবল দারিদ্র্য নয়, প্রতিনিয়ত লড়ছে নদীর ভয়াবহ ভাঙনের বিরুদ্ধেও। কখন কোন দিন ঘুম থেকে উঠে দেখবে ঘরটা নদীতে তলিয়ে গেছে এই আশঙ্কা সবসময় তাদের সঙ্গী। তবুও তারা আশাবাদী। তাদের চোখে এখনো ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

লালমনিরহাট চর উন্নয়ন কমিটির সংগঠক নজরুল ইসলাম জানান, চরের শিশুদের নিয়ে কেউ কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় কথা বলে না। তাদের ভবিষ্যৎ যেন মাটির ধুলায় ঢাকা পড়ে থাকে। অথচ একটু সুযোগ, সহানুভূতি ও সমর্থন পেলে এই শিশুরাই বদলে দিতে পারে একটি জাতির গল্প।

তিনি আরো জানান, চরের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে হলে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় দরকার। এজন্য আমরা চর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য আবেদন করে আসছি।” তার মতে, চরের শিশুরা শুধু শ্রম দিতে জানে না, স্বপ্ন দেখতেও জানে; আর সেই স্বপ্নই একদিন ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে, যদি তাদের হৃদয়ের ভাষা শোনা যায়।

স্বাআলো/এস

Shadhin Alo