যুদ্ধের অপেক্ষায় ট্রাম্প: রাজনীতি না কৌশল?

মধ্যপ্রাচ্য আবারও রক্তাক্ত। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সামরিক সংঘর্ষ পঞ্চম দিনে গড়িয়েছে। একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে তেহরান, অন্যদিকে গাজা উপত্যকা থেকে গলান হাইটস পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে গোলাবর্ষণের পাল্টা প্রতিক্রিয়া। এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়েছে, যাদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। রাষ্ট্রীয় টিভি ভবন, সামরিক ঘাঁটি, আবাসিক ভবন—সবই পরিণত হয়েছে লক্ষ্যবস্তুতে। এমন এক অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, “আমরা এখন ইরানের আকাশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি।”
এই ঘোষণা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিকে নয়, বিশ্ব রাজনীতির মোড়কেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্ন এখন—ট্রাম্পের এই বক্তব্য কি তাৎক্ষণিক আবেগজাত প্রতিক্রিয়া, নাকি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশলের অংশ?
কৌশলগত নীরবতা
আল জাজিরা আরবির বর্ষীয়ান বিশ্লেষক লিক্বা মাকি মনে করেন, ট্রাম্পের এই দ্ব্যর্থক অবস্থান আসলে একটি সুচিন্তিত ‘কৌশলগত নীরবতা’। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন না ঠিকই, কিন্তু এমন বার্তা দিচ্ছেন যা শত্রুপক্ষকে আতঙ্কিত করে ও মিত্রদের আশ্বস্ত করে। তিনি অপেক্ষা করছেন সেই সুনির্দিষ্ট মুহূর্তের, যখন ইরান কৌশলগতভাবে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে পৌঁছাবে—অর্থাৎ যখন ইরান তার পাল্টা প্রতিরোধের সক্ষমতা হারাবে এবং তখন যুক্তরাষ্ট্র মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসবে।
এই ধরণের সময়নির্ভর “কৌশলগত ধৈর্য” যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। আফগানিস্তান, ইরাক, এমনকি সিরিয়ায়ও দেখা গেছে—সামরিক হস্তক্ষেপের সময় নির্ধারিত হয়েছে কেবলমাত্র কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার পরে।
গৃহীত সিদ্ধান্ত, কিন্তু সর্বসম্মত নয়
ট্রাম্পের এই আগ্রাসী মনোভাবের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে তৈরি হয়েছে ভিন্ন সুরের এক পরিসর। কংগ্রেসের প্রভাবশালী রক্ষণশীল নেত্রী মার্জোরি টেইলর গ্রিন এক টুইটে লিখেছেন—“আমেরিকার জনগণের ট্যাক্সের অর্থ বিদেশি যুদ্ধ নয়, বরং ঘরোয়া সংকট যেমন শিক্ষাব্যবস্থা, গৃহহীনতা এবং স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় হওয়া উচিত।”
এই বক্তব্য শুধু নীতিগত প্রশ্নই তোলে না, বরং মার্কিন জনমতের যুদ্ধবিরোধী সুরকে তুলে ধরে। সাম্প্রতিক একাধিক জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ চায়—বিদেশি সংঘাতে যুক্ত হওয়ার বদলে সরকার যেন বেশি মনোযোগ দেয় নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে।
এই অভ্যন্তরীণ বিভাজন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধনীতিকে শুধু দুর্বল করে না, বরং সামগ্রিক প্রশাসনিক স্থিতিশীলতাও প্রশ্নের মুখে ফেলে। এমন অবস্থায় ট্রাম্পের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ হতে পারে এক ধরনের রাজনৈতিক ঝুঁকি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুদ্ধ: কূটনীতি না শো?
বিগত দুই দশকে বৈশ্বিক রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে অনেক সময় যুদ্ধ হয়ে ওঠে ‘পলিটিক্যাল থিয়েটার’। ক্যামেরার সামনে কঠিন বিবৃতি, সামরিক প্রস্তুতির নাটকীয়তা, এবং যুদ্ধবিমুখ অবস্থানের ভান—এসবই এখন অনেক রাষ্ট্রনেতার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বাড়ানোর অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্পও ব্যতিক্রম নন। অতীতেও ট্রাম্প প্রশাসন অভ্যন্তরীণ সংকট এড়াতে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ২০২০ সালের শুরুতে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা সেই কৌশলেরই প্রতিফলন। একইভাবে, এবারও যদি তিনি যুদ্ধ শুরুর নাটক করেন, তবে তা হতে পারে নির্বাচনের আগে তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর এক কৌশলী পদক্ষেপ।
গণতন্ত্রের মুখোমুখি বিপর্যয়
যুদ্ধ কেবল মানুষের প্রাণ নেয় না—নিয়ে যায় গণতন্ত্রের আস্থা, মানবতার সৌন্দর্য এবং রাজনৈতিক নৈতিকতা। যখন যুদ্ধ ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন রাজনীতি তার মানবিকতা হারায়।
আজকের বিশ্ব এক জটিল সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—যেখানে শক্তি ও আধিপত্য নয়, বরং কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা, সহনশীলতা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাধানই হয়ে উঠতে পারে মানবজাতির একমাত্র পথ। কিন্তু যখন রাষ্ট্রনেতারা যুদ্ধকে ব্যবহার করেন রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে, তখন শুধু যুদ্ধক্ষেত্র নয়—পরাজিত হয় গণতন্ত্রও।
শান্তি না রাজনীতি?
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা কি সত্যিই আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য প্রয়োজনীয়, না কি এটি একমাত্র ট্রাম্পের রাজনৈতিক ‘ক্যারিশমা’ ফেরানোর হাতিয়ার? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু ইতিহাস বলে—যেখানে যুদ্ধ রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, সেখানেই গণতন্ত্র, মানবতা ও শান্তি দীর্ঘমেয়াদে হারিয়ে যায়।
লেখক: মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক