গত ১৩ জুন আকস্মিক এক হামলার জেরে ইসরায়েলের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘাতে জড়ানোর পর অবশেষে ১২ দিনের মাথায় সোমবার (২৪ জুন) যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এসেছে।
এই সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রও। তবে প্রশ্ন উঠছে, এই যুদ্ধবিরতি কি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ খুলে দিল, নাকি আরো বড় কোনো সংঘাতের আগে এটি কেবল একটি সাময়িক বিরতি?
এই সংঘাতকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যুদ্ধ শেষ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানের নেতারা প্রত্যেকেই নিজেদের শর্তে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে বলে দাবি করছেন। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত নতুন করে বড় কোনো হামলার খবর পাওয়া যায়নি দুপক্ষ থেকে।
সংঘাতের সূত্রপাত ও বিস্তার:
সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে ১৩ জুন, যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছিল। আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় ইসরায়েল আকস্মিকভাবে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটিতে ভয়াবহ হামলা চালায়। এই হামলায় ইরান তাদের সেনাপ্রধানসহ ২০ জনের বেশি শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হারায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলের এই হামলার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন জানান।
এরপর অনুমিতভাবেই ইরান ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। প্রথমদিকে মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েলের বিপক্ষে ইরানের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তারা ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যত অকার্যকর প্রমাণ করে চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে থাকে। ইসরায়েলের পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হয়ে পড়ে যে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি তাদের পক্ষে ইরানে অভিযানের আহ্বান জানান। এমনকি সাধারণ ইসরায়েলিরাও ট্রাম্পকে সহায়তার আহ্বান জানান। অবশেষে সংঘাতের নবম দিন রাতে মার্কিন বাহিনী ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় ভয়াবহ ক্লাস্টার বোমা হামলা চালায়। এই পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছিল, মধ্যপ্রাচ্য হয়তো একটি দীর্ঘ ও বিস্তৃত যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে।
ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা ও বিতর্ক:
কিন্তু, ১২তম দিনে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ‘সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্ত’ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ঘোষণা দেন সোমবার (২৪ জুন)।
তবে, ট্রাম্পের এই ঘোষণার চার ঘণ্টা পরই ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর দাবি করে। তাদের দাবি ছিল, ইরান থেকে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল, যা প্রতিহত করা হয়েছে। এর জবাবে ইসরায়েল তেহরানের কাছে একটি রাডার স্টেশন ধ্বংস করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি সত্যিই অসন্তুষ্ট যে ইসরায়েল হামলা করেছে। তিনি আরও বলেন, দুটি দেশ এত দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর লড়াই করছে যে তারা জানে না তারা কী করছে।
ইসরায়েলি হামলায় ইরানে প্রাণ গেছে ৬০৬ জনের
অবশ্য ইরান এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কথা অস্বীকার করে। এরপর যুদ্ধবিরতি আবার কার্যকর হয়। ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন এবং ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালাবে না। সমস্ত বিমান ফিরে আসবে এবং ইরানকে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ‘প্লেন ওয়েভ’ দেবে। কেউ আঘাত পাবে না, যুদ্ধবিরতি কার্যকর!
ভবিষ্যৎ পথ ও পারমাণবিক কর্মসূচি:
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুইটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পথ রয়েছে।
একটি পথ হলো, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর পুনরায় জাতিসংঘ পরিদর্শন এবং ইরানের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি, যা সম্ভবত ২০১৫ সালের তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)-এর মতো হতে পারে। এটি তেহরানকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর বৈশ্বিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এখানে ইউরোপীয় শক্তিধর দেশগুলো (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গত ২০ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া ক্যাল্লাসসহ এই তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন হামলা এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু, রয়েছে ধোঁয়াশা
এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রাজনীতি বিষয়ের সহযোগী প্রভাষক ইয়ানিস কোটৌলাস আল জাজিরাকে বলেন, ইরান উন্নত পর্যবেক্ষণ প্রস্তাব করে এবং তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ইউরোপীয়দের কূটনৈতিকভাবে জড়িত করার চেষ্টা করবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইতোমধ্যেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।
তবে, এই পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। ইসরায়েল অতীতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের যেকোনো পারমাণবিক চুক্তি বানচাল করার চেষ্টা করেছে এবং নতুন চুক্তি সহজে মেনে নেবে না। সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আগের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসা, সাম্প্রতিক আলোচনায় লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করা এবং তারপর একটি চুক্তির আলোচনা চলার সময়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের বোমা চালানো– এই প্রেক্ষাপটে তেহরান আদৌ কোনো আপসে রাজি হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে।
অন্যদিকে, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে অনড় থাকলে অন্য পথটি খুলে যেতে পারে। সোমবার ইরানের সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি একটি বিল অনুমোদন করেছে, যেখানে তারা জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার সঙ্গে তেহরানের সহযোগিতা সম্পূর্ণ স্থগিত করার কথা বলেছে। এদিকে, মঙ্গলবার ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি কোনোভাবেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করতে দেবেন না।
এ অবস্থায় ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে অনড় থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক দফা হামলা এবং তার জবাবে ইরানের পাল্টা হামলা কেবল সময়ের ব্যাপার হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, এই যুদ্ধবিরতি কি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ খুলে দিল, নাকি আরও বড় কোনো সংঘাতের আগে এটি কেবল একটি সাময়িক বিরতি?
স্বাআলো/এস