করোনা ভাইরাস, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া—একসাথে তিনটি সংক্রামক রোগের প্রকোপে নতুন করে স্বাস্থ্যসংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর ও মফস্বল পর্যন্ত এই রোগগুলোর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনটি রোগ একসাথে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তীব্র চাপ পড়বে।
বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। সেইসঙ্গে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন দেশে প্রবেশ করায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ।
২০২৫ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে আবারও করোনায় একদিনে পাঁচজনের মৃত্যু ঘটে, যা প্রায় দেড় বছর পর নতুন শঙ্কার জন্ম দেয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত দেশে করোনায় শনাক্ত হয়েছেন ৫১৮ জন, মারা গেছেন ১৯ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন উপধরন XFG ও XFC, ওমিক্রনের JN.1-এর শাখা হিসেবে ছড়াচ্ছে দ্রুত। এই ধরনের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হলেও মৃত্যুহার তুলনামূলক কম। তবে প্রবীণ, দুর্বল রোগী ও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এটি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “নতুন ভ্যারিয়েন্টে প্রতি ১০০ জনে একজন সিভিয়ার রোগী হলে, প্রতি লাখে ১০০ জন সিভিয়ার রোগী পাওয়া যাবে—যা এককথায় উদ্বেগজনক।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জনের। এর মধ্যে জুনেই মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। এ বছর মোট আক্রান্ত ৯ হাজার ৬৫ জন, তবে এই সংখ্যা শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের হিসাব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরিশাল, খুলনা, ও ময়মনসিংহ বিভাগে এবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলক বেশি। নগর কর্তৃপক্ষের মশক নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও জনসচেতনতার অভাবে এই রোগের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না।
ডা. নজরুল ইসলাম, সাবেক উপাচার্য, বিএমইউ বলেন, “যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি ছাড়া মহামারি মোকাবিলা সম্ভব নয়। এখনই স্বাস্থ্যখাতে সমন্বিত কার্যক্রম নিতে হবে।”
করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া: এক নজরে ঝুঁকি ও করণীয়
রোগ | আক্রান্ত (২০২৫) | মৃত্যু | করণীয় |
---|---|---|---|
করোনা | ৫১৮ | ১৯ | মাস্ক ব্যবহার, হেলথ স্ক্রিনিং, ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ |
ডেঙ্গু | ৯,০৬৫ | ৩৮ | মশক নিয়ন্ত্রণ, দ্রুত পরীক্ষা, অবজারভেশন ওয়ার্ড |
চিকুনগুনিয়া | ৮২% নমুনায় শনাক্ত | মৃত্যু নেই | জনসচেতনতা, চিকিৎসা প্রশিক্ষণ |
আইসিডিডিআরবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে তাদের পরীক্ষাকৃত রক্তের নমুনার ৮২ শতাংশেই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে ঢাকায় এই রোগে ১৩ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা পরে ছড়িয়ে পড়ে ২৩টি জেলায়।
চিকুনগুনিয়া মারাত্মকভাবে মৃত্যুর কারণ না হলেও রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। গিঁটে ব্যথা, মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া এবং স্নায়বিক সমস্যা রোগীকে কার্যক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “এটা (চিকুনগুনিয়া) খুব কষ্টদায়ক। যদিও তেমন মৃত্যু হয় না, কিন্তু ভোগান্তি অনেক বেশি। চিকিৎসকদের এখন থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই তিন রোগ একসাথে বিস্তার লাভ করলে সাধারণ হাসপাতালে রোগী সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাই এখনই প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বড় হাসপাতালগুলোতে আলাদা ‘অবজারভেশন ওয়ার্ড’ চালু করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, “যদি একজন রোগী ডেঙ্গু বা করোনা সন্দেহে হাসপাতালে আসে, আর জায়গা না থাকায় বাড়ি ফিরে যায়, পরে সে যদি আক্রান্ত হয়—তাহলে অন্যদের জন্যও সে হুমকি হয়ে উঠবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের হাসপাতালে অবজারভেশন ওয়ার্ড ও ট্রিটমেন্ট ইউনিট তৈরি করতে হবে। ডেঙ্গু ও করোনা রোগীদের সঙ্গে সাধারণ রোগীদের রাখা ঠিক নয়।”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো যথাযথভাবে ফগিং বা লার্ভিসাইড ব্যবহার করছে না। অনেক ক্ষেত্রে মশার বংশবিস্তারের স্থানে নজর দেওয়া হচ্ছে না।
“তিন দিনের বেশি কোথাও পানি জমে থাকলে সেখানে মশার লার্ভা জন্মে। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন নিয়মিত ফগিং চালাতে হবে,” বলেন ডা. নজরুল ইসলাম।
করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া একসাথে বিস্তার লাভ করলে দেশের স্বাস্থ্য খাতের ওপর প্রবল চাপ পড়বে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই সমন্বিত প্রস্তুতি গ্রহণ না করলে তা বড় বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।