ফেনীর সোনাগাজীর পাটগাছিয়ায় দুই শিশুর মুরগি ও কবুতর চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে তাদের মায়েদের জনসমক্ষে ‘নাকে খত’ দিতে বাধ্য করার ঘটনা বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতার অপব্যবহার কতটা ভয়াবহ ও লজ্জাজনক রূপ নিতে পারে, তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি বহুদিন ধরে চলে আসা এক ধরনের সমাজ-নিয়ন্ত্রিত ‘ক্ষমতার বিচারব্যবস্থা’র নগ্ন প্রকাশ। যেখানে আইন ও মানবিকতা নয়, সিদ্ধান্ত নেয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। বিচার হয় জনসমক্ষে, অপমান আর হেয় করার মাধ্যমে।
পহেলা মের ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। দৃশ্যত এক শান্তিপূর্ণ গ্রামে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে ক্ষমতা, রাজনীতি এবং বিচারহীনতার ভয়ংকর চক্র। ভিডিওতে দেখা যায়, দুই নারীকে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে অপমানজনক ভঙ্গিতে জনসমক্ষে ‘ক্ষমা চাইতে’ বলা হচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘জনরোষ সামলাতে’ তিনি উপস্থিত লোকজনের পরামর্শে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- একজন সাবেক জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব কি জনরোষে তুষ্ট হয়ে আইন ভঙ্গ করা, নাকি সমাজে শান্তি ও আইনের শাসন রক্ষা করা? ‘জনরোষের নামে নারীদের অপমানের এই ‘বিচার’ কি আদৌ ন্যায়বিচারের অংশ হতে পারে?
এই ঘটনার পেছনে একটি স্পষ্ট বার্তা রয়েছে ক্ষমতার দাপট থাকলে আপনি বিচারক হয়ে যেতে পারেন, আপনি আইন নিজের মতো প্রয়োগ করতে পারেন। আপনি চাইলে কাউকে জনসমক্ষে লাঞ্ছিত করতে পারেন, তার জন্য থানায় মামলা করতে হবে না, আদালতের আদেশ লাগবে না। এই মনোভাব শুধু ভয়ংকর নয়, এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য হুমকিস্বরূপ।
ফেনীর এই ঘটনায় পুলিশ জানায়, তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অথচ সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে, ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজের ভূমিকা স্বীকার করছেন—তা সত্ত্বেও পুলিশ ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে’ বলে দায় ঝেড়ে ফেলেছে। এটি বাংলাদেশের বহুদিনের পরিচিত চিত্র ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে পুলিশ নীরব, নির্যাতিতদের প্রতি সহানুভূতি নেই, আর সমাজের চোখে ‘চোর’ বা ‘অপরাধী’ হয়ে গেলে ন্যায়বিচারের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
এ ঘটনাটি স্পষ্ট করেছে, গ্রামীণ সমাজে এখনো অনেকাংশেই বিচারব্যবস্থা একপ্রকার সামাজিক শো-ডাউন। সেখানে যারা শক্তিশালী, তাদের কথাই ‘আইন’। স্থানীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় এই ক্ষমতাবানরা নিজেরাই পুলিশ, নিজেরাই বিচারক। ফলে, আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে।
ঘটনার আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো অপরাধে অভিযুক্ত শিশুরা নয়, তাদের মায়েরা শাস্তি পেলেন। এটাই আমাদের সমাজের বহুল প্রচলিত অন্যায় মানসিকতা—যেখানে নারীদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অপরাধের দায় কাঁধে নিতে হয়, অপমান সহ্য করতে হয়। এই লিঙ্গবৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে নারীর অবস্থান কতটা দুর্বল, সেটাই তুলে ধরে।
ফেনীর ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বহু মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে এই ঘটনার জন্য দায়ী প্রভাবশালীদের কি আদৌ শাস্তি হবে? নাকি যথারীতি কিছুদিন পর সব ভুলে যাওয়া হবে? আমরা ভুলে গেলে চলবে না- এই রকম একেকটি ঘটনা কেবল একটি পরিবারকে নয়, পুরো সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজে ভয়, অনাস্থা, এবং বিদ্বেষ বাড়ে। মানুষ আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আর প্রতিকার খোঁজে ভিন্ন পথে।
এই ঘটনার পর এখন জরুরি হলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর হস্তক্ষেপ, প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, এবং সামাজিকভাবে এই ধরনের ‘শাস্তিমূলক লাঞ্ছনা’র সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা। সরকারকে স্পষ্ট করে বলতে হবে কোনো জনরোষের ভিত্তিতে, কোনো রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছায়, কিংবা কোনো লোকাচারের অজুহাতে, কেউ কাউকে জনসমক্ষে অপমান করতে পারে না।
এই সমাজ যদি সত্যিই ন্যায়ভিত্তিক হতে চায়, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে ন্যায়ের নামে অপমানের এই উৎসব এক ভয়ানক প্রবণতা। এই প্রবণতার মূল উৎস ক্ষমতার অপব্যবহার, যেখানে বিচার নয়, প্রতিশোধ আর সামাজিক হেয়প্রতিপন্ন করাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
এখানে ‘নাকে খত’ কোনো বিচারের প্রতীক নয়, এটি একটি প্রতাপশালী গোষ্ঠীর ‘ক্ষমতা দেখানোর’ হাতিয়ার। এর পেছনে থাকে সেই বার্তা—“আমরা যা চাই, তাই হবে।” এটি এমন এক সমাজ তৈরি করে যেখানে দুর্বলরা ভয় পায়, এবং অন্যায়কারীরা উৎসাহ পায়।
আমরা যদি সত্যিকারের সুবিচার চাই, তাহলে ন্যায়বিচারকে মুখোশ নয়, মূল চালিকা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক জবাবদিহিতা, আইনগত কঠোরতা, এবং সর্বোপরি, নাগরিকদের মানবিক বোধ ও দায়িত্বশীলতা।
এই ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আইন কেবল কাগজে থাকলেই চলে না তার বাস্তব প্রয়োগই সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। আর ন্যায়ের নামে যদি অপমান চলে, তবে সেটি শুধু অন্যায় নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
এই দেশে শিশুদের ভবিষ্যৎ যেনো হয় স্বাধীন, নারীদের মর্যাদা যেন হয় অখণ্ড, এবং কোনো ক্ষমতাবানের ইচ্ছায় যেন আর কাউকে ‘ন্যায়ের মুখোশে’ অপমানিত না হতে হয় এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী
স্বাআলো/এস