কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এটি বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ।
কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে যান চলাচল শুরু হচ্ছে চলতি মাসের শেষেই। দুটি টিউবের মাধ্যমে দেশের প্রথম এ টানেলটিতে থাকছে আসা-যাওয়ায় চারটি লেন, থাকছে পানির নিচে সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ ব্যবস্থা। এছাড়া দুইপাড়ে প্রায় ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক।
উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় নতুন সঙ্গী কর্ণফুলী নদীর নিচে বঙ্গবন্ধু টানেল। সব কাজ শেষ। এখন শুধু অপেক্ষা মাত্র ৮ দিনের, ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলীর এপার থেকে ওপাড় পাড়ি দিয়ে উদ্বোধন করার আনুষ্ঠানিকতা। পরের দিন ২৯ অক্টোবর সাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে দেশের প্রথম এ সুড়ঙ্গপথ।
পানির উপরিভাগ থেকে ৪২.৮ মিটার গভীরে নদীর তলদেশে টিউবের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে চলাচলের এ বিশেষ পথ। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩১২ কিলোমিটার। টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫০ কিলোমিটার। দুটি টিউবের একটি আসার জন্য, আরেকটি যাওয়ার জন্য।
পানির উপরিভাগ থেকে এতো গভীরে যেকোনো দুর্ঘটনা এড়াতে কী ব্যবস্থা থাকছে। ১০.৮০ ব্যাসের এ টানেলে মাঝবরাবর চলাচলের পথ। মাঝে তিনটি ক্রস প্যাসেজের মধ্যে যুক্ত থাকছে দুটি টানেল। যেকোনো আনাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দুই থেকে তিন মিনিটে পৌঁছে যাবে কুইক রেসপন্স টিম। এছাড়া নিচের অংশে থাকছে বিশেষ সার্ভিস লেন। যা থেকে খুব সহজেই চলে যাওয়া যাবে টানেলের দুই প্রান্তে।
টানেলের প্রকল্প সূত্র জানায়, সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সেখানে ১০০টিরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সেই সঙ্গে টানেলে কোনোভাবেই ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চলতে পারবে না বলেও নির্দেশনা দেয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক আব্দুল হালিম বলেন, টানেলে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে ৮০ মিটার পর পর রয়েছে জরুরি ভিত্তিতে বের হওয়ার ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে টানেলের ৫০০ থেকে ৬০০ মিটারের মধ্যে তিনটি ক্রস প্যাসেজ আছে। যার মাধ্যমে একটি থেকে আরেকটিতে দ্রুত চলে যাওয়া যাবে। বিশ্বমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আধুনিক নির্মাণশৈলী ব্যবহার করেই টানেল প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে হবে নিরাপদ যাত্রা। ফ্লাডগেইট থাকায় টানেলে যেমন পানি প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই, তেমনি ২০ মিটারের নিচে ভূমিকম্পে কোনো কম্পন অনুভূত হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সময় ১০ থেকে ৩০ ফুট এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ১২ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের ঘটনার সঙ্গে প্রায় পরিচিত চট্টগ্রামবাসী। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি টানেল অবস্থিত হওয়ায় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসে পানি ঢুকে কর্ণফুলী টানেল প্লাবিত হতে পারে কি না এমন প্রশ্ন রয়েছে জনমনে। তবে বিশ্বমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করে টানেল প্রস্তুত হওয়ায় কোনো রকম ঝুঁকির আশঙ্কা নেই।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ জানান, টানেলের দুটি টিউবের দুই প্রান্তেই রয়েছে ফ্লাডগেইট। ম্যানুয়ালি ২০ মিনিটের মধ্যেই এসব বন্ধ করা সম্ভব। ফ্লাডগেইটটি এমনভাবে প্রস্তুত করা, যা দিয়ে পানি ঢোকার নেই কোনো সুযোগ।
প্রথম বছরে এ টানেল দিয়ে ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি পারাপার হবে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। একই সঙ্গে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং মিরসরাই ইকোনোমিক জোনের যোগাযোগ স্থাপনে সেতুবন্ধন হবে চট্টগ্রাম বন্দর।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, ভবিষ্যতে আমরা এ অঞ্চলটিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে রূপান্তর করবো, তাই আমাদের জন্য বঙ্গবন্ধু টানেল একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠোমো।
প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৯.৩৯ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে ৫.৩৫ কিলোমিটার এপ্রোচ রোড, আর ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজ। এ টানেল চট্টগ্রাম শহর থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের যাত্রাপথ অন্তত দেড় ঘণ্টা কমিয়ে আনবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এ টানেল উদ্বোধন করার কথা।
চীনের সাংহাইয়ের আদলে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তিন দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আগামী পাঁচ বছর টানেলটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বেও থাকবে প্রতিষ্ঠানটি।
স্বাআলো/এসএ