টানা ১২ দিনের তীব্র সংঘাত শেষে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বর্তমানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম ভয়াবহ এই সংঘাতে ইরানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইসরায়েলের লাগাতার হামলায় নয় শতাধিক ইরানি নিহত হওয়ার পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ অন্তত ২৪ জন শীর্ষ কমান্ডার ও ১৪ জন পরমাণু বিজ্ঞানী প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানও, যার মাধ্যমে ইরানের ‘কোমর ভেঙে দেওয়ার’ পরিকল্পনা ছিল বলে জানা গেছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকলেও, এই স্থিতিশীলতা কতদিন বজায় থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, তেহরান এই যুদ্ধবিরতিকে কেবল একটি কৌশলগত বিরতি হিসেবে দেখছে। মিডল ইস্ট আইয়ের খবর অনুযায়ী, কৌশলগত ধৈর্য নীতির অংশ হিসেবে ইরান এখন নিজেদের নতুন করে সাজাচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইরান সাম্প্রতিক সংঘাতকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটি চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ হিসেবে দেখছে। অতীতের ইরান-ইরাক যুদ্ধের মতোই ইরান বিশ্বাস করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজয় আসবে। আর সেই সময়কে কাজে লাগাতেই তারা এই কৌশলগত বিরতির পথ বেছে নিয়েছে।
চীনে ইরান, রাশিয়া এবং চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈঠক
১২ দিনের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের সময় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ হামলায় ইরান সামরিক কমান্ড এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের বড় একটি অংশ হারিয়েছে। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র অবকাঠামোরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যদিও ইরানও পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলার দাবি করেছে।
বর্তমানে ইরান নিজেদের সামরিক শক্তি নতুন করে গড়ে তোলায় মনোযোগ দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে তারা স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত বৃদ্ধি করছে, ‘ফাতাহ’ ও ‘খাইবার শেকান’-এর মতো নতুন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি যুক্ত করছে এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছে। ১২ দিনের যুদ্ধে ইরান উপলব্ধি করেছে যে, আধুনিক যুদ্ধে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনের ওপর নির্ভর করে জয়ী হওয়া কঠিন। তাই তারা ইতোমধ্যে রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সু-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। পাশাপাশি চীনের জে-১০ এবং পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ যুদ্ধবিমানও কেনার কথা ভাবছে তেহরান।
আকাশভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থার ঘাটতি ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে স্পষ্ট হয়েছে। তাই চীন বা রাশিয়া থেকে এ ধরনের প্রযুক্তি সংগ্রহকে তেহরান এখন অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি: আসলেই শেষ নাকি ‘বড় যুদ্ধ’ আসন্ন?
তেহরানের কাছে ‘কৌশলগত ধৈর্য’ কেবল অপেক্ষা করা নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধেরও অংশ। তাই সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি ইরান এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি ও কূটনৈতিক লড়াইয়ের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। তারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করার পরিকল্পনা করছে।
তেহরান জানিয়েছে যে, এই আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা পারমাণবিক আলোচনায় ফিরবে না। এরই মধ্যে ইরান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে। যুদ্ধের আগে গোপনে বিপুল পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা হয়েছে বলেও জানা গেছে, যা এখনো অক্ষত রয়েছে। এই মজুত ভবিষ্যতে তাদের কৌশলগত চাপের একটি বড় অস্ত্র হতে পারে।
ইরান কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলের ভেতরের ও বাইরের চাপ বাড়বে। আর এ সময়কে কাজে লাগিয়েই তারা নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি তাই প্রকৃত শান্তি নয়, বরং আরও বড় এবং দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের জন্য ইরানের একটি কৌশলগত প্রস্তুতি পর্ব।
স্বাআলো/এস