বাল্যবিয়ের বলি আশামনি, আইনি লড়ায়ের নেই হাতিয়ার

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট

বাল্যবিয়ের বলি ৭ম শ্রেণির ছাত্রী আশামনির সংসার ভেঙে চুরমার হলেও আইনি লড়াইয়ের হাতিয়ার খ্যাত কাবিননামা নেই তার। তরুনী মেয়ের জীবন রক্ষায় ন্যায় বিচারের আশায় দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরছেন বাবা জাহাঙ্গীর আলম। ন্যায় বিচার ও মেয়ের সুস্থ জীবনে ফেরার বিচার দুদক চেয়ারম্যান পর্যন্ত অবগত রয়েছেন। তবুও মিলছে না ন্যায় বিচার প্রাপ্তি।

তরুনী গৃহবধূ আশামনি লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের কর্ণপুর সরকারটারী গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে স্থানীয় মোগলহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী এবং একই এলাকার মজিদুল ইসলামের ছেলে মুয়াজ্জিন নুর মোহাম্মদের স্ত্রী।

স্থানীয়রা ও আশামনির পরিবার জানায়, বাড়ির পাশে সরকারটারী জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন নুর মোহাম্মদ সকালে মসজিদের মক্তব পড়াতেন। আশামনি স্থানীয় মোগলহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী থাকা অবস্থায় স্কুলে যাবার আগে সকালে প্রতিদিন ওই মক্তবে পড়ত। সেখানে চেনাজানা হয় মুয়াজ্জিন নুর মোহাম্মদের সাথে। চেনাজানা থেকে প্রেম। অতপর প্রেমের টানে গত ২০২২ সালে প্রেমিক নুর মোহাম্মদের ডাকে তার বাড়িতে অবস্থান নেয় ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ছাত্রী আশামনি। বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীয়রা আশামনি ও নুর মোহাম্মদের বিয়ে দেন। তবে আশামনি বয়স ১৫ বছর হওয়ায় বিয়েটা তাদের রেজিস্ট্রি না হলেও মুসলিম শরীয়া মোতাবেক বিয়ে পড়ান স্থানীয় এক ইমাম। রেজিস্ট্রিহীন এ বাল্যবিয়েই কাল হয়ে দাঁড়ায় আশামনি ও তার পরিবারের।

‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি হটলাইন নম্বরের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে’ হুসাইন শওকত

বিয়ের কিছু দিন পরে মেয়ের কথা ভেবে বিয়ে মেনে নেন তার পরিবার। কিন্তু নুর মোহাম্মদের থাকার মত তেমন কোন ঘর না থাকায় ঘর করার মত টাকা দাবি করা হয় আশামনির পরিবার থেকে। সেই ঘর না হওয়া পর্যন্ত আশামনিকে তার বাবার বাড়িতে রাখেন নুর মোহাম্মদ। বিয়ের তিন মাসের মধ্যে তাদের মাঝে ঘর করার টাকাসহ নানান বিষয়ে বিবাদ তৈরী হয়। আশামনির কাছে যাতায়ত ও যোগাযোগ বন্ধ করেন স্বামী নুর মোহাম্মদ।

মেয়ের সংসার ফেরাতে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিয়ের কাবিননামা না থাকায় তা গ্রহন করা সম্ভব হয়নি তা পরিবারের। অপরদিকে আইনি পদক্ষেপ না নিলে স্বামী নুর মোহাম্মদও গ্রহন করছেন না তার স্ত্রীকে। অবশেষে বিয়েকে অস্বীকার করে গত ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর নুর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে সদর থানায় অপহরন ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন আশামনির বাবা জাহাঙ্গীর আলম।

সদর থানা পুলিশ মামলায় অভিযুক্ত নুর মোহাম্মদের বাড়ির পাশ থেকে ভিক্টিম আশামনিকে উদ্ধার পুর্বক ডাক্টারী পরীক্ষা করেন। তৎকালিন লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের চিকিৎসক গাইনী সার্জন ডা. এলিনা পারভীন চিকিৎসা সনদে ধর্ষণের কোন আলামত নেই বলে মতামত প্রদান করেন। অপর দিকে গত ২৩ সালের ২৩ মার্চ মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠান তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মুক্তা সরকার। যেখানে মামলার তথ্যগত ভুল দাবি করে মামলা থেকে আসামী নুর মোহাম্মদকে অব্যাহতি প্রার্থনা করেন। বাদির আর্জির প্রক্ষিতে আদালত মামলাটি পুন তদন্তের দায়িত্ব দেন সিআইডিকে।

এ মামলাকে ঘিরে সমাজের লোকজন তাদের পরিবার নিয়ে নানান খারাপ মন্তব্য শুরু করেন। যার কারনে লোকলজ্জার ভয়ে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে আশামনি ও তার বোন রিতামনি। সে সময় ৮ম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনও করা হয়নি তাদের। পরবর্তিতে রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তাদের নাম খাতা থেকে কেটে দেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

মেয়ে আশামনির ন্যায় বিচারে প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে দুদকের গনশুনানিতে অভিযোগ করেন বাদি জাহাঙ্গীর আলম। গত ২১ এপ্রিল লালমনিরহাটে গনশুনানিতে দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন সদর থানাকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হলে সদর থানার ওসি গণশুনানীতে বলেন, স্বাক্ষী না থাকায় ধর্ষণ মামলাটির ফাইনাল দেয়া হয়েছে। এ সময় সদর থানার প্রতিউত্তরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মানুষ গরু ছাগল নয় যে সবার সামনে ধর্ষন করবে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে আইনী সেবা প্রদান করতে সদর থানাকে তাগিদ প্রদান করেন দুদক চেয়ারম্যান। যার প্রেক্ষিতে মামলাটি তদন্তে মাঠে নামেন সিআইডি লালমনিরহাট।

এদিকে এমন ঘটনার কারনে বাদি জাহাঙ্গীর আলমের বিপক্ষে অবস্থান নেন স্থানীয় একটি মহল। দুদক চেয়ারম্যানের কাছে গনশুনানীতে অভিযোগ করায় ওই মহলটি গত সপ্তাহে তার বাড়ির সামনে মানববন্ধন করে তার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার দাবি করেন। এতে আশামনিসহ তার পরিবারটি সামাজিক ভাবে অনেকটা এক ঘরো হয়ে পড়েছে। বাদি জাহাঙ্গীর আলম হোমিও চিকিৎসা কেন্দ্রটি বন্ধ করে বাড়িতে অবস্থান করছে লোকলজ্জার ভয়ে। মেয়েদের পুনরায় ভর্তি করে নেয়ার ব্যবস্থা করতে গত ১৫ এপ্রিল জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবরে লিখিত আবেদন করেন আশামনির বাবা জাহাঙ্গীর আলম। শিক্ষা জীবনও ধ্বংসের পথে এ দুই তরুনীর। একটি বাল্যবিয়ে আর্থিক ও সামাজিক ভাবে পুরো পরিবারকে টেনে পথে নেমে দিয়েছে।

অন্যদিকে আশামনির স্বামী মসজিদের সাবেক মুয়াজ্জিন নুর মোহাম্মদ নিজে ফতোয়া দিয়ে নতুন করে নিকট আত্নীয়কে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন। কথা হলে নুর মোহাম্মদ বলেন, কোন স্বামী স্ত্রীর মাঝে চার মাস যোগাযোগ বন্ধ থাকলে সেই স্ত্রী স্বাভাবিক ভাবে তালাক হয়ে যায়। চার মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ায় আশামনির সাথে সম্পর্ক অটো বিচ্ছেদ হয়েছে বলেই নিকট এক আত্নীয়কে বিয়ে করেছি। মুখে বা কাগজে তালাক না দিলেও ইসলাম মতে তা তালাক কার্যকর হয়েছে।

আশামনি বলেন, আমি সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই চাই। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করে নিলে আমি পুনরায় বিদ্যালয় মুখি হতে চাই। একই সাথে বিচার চাই সেই নুর মোহাম্মদের। যে জীবন নিয়ে খেলা করে পুরো পরিবারকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। লোক লজ্জায় আমরা পরিবারের কেউ বাহিরে বের হতে পারছি না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

বাদি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার মেয়ের জীবন নিয়ে যারা খেলতেছে তাদের বিচার চাই। টাকার জোরে সকলকে ম্যানেজ করে বিবাদিরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ আমরাই ঘর বন্দি হয়ে পড়েছি।

মোগলহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক(ভারপ্রাপ্ত) সাইদুল ইসলাম বলেন, আশামনি ও রিতামনি দুই বোন ৮ম শ্রেণিতে কয়েক দিন ক্লাস করে আর বিদ্যালয়ে আসেনি রেজিস্ট্রেশনও করেনি। আমরা ভেবেছি বিয়ে হয়েছে তাই হয়তো পড়বে না। গ্রামের বিদ্যালয়ে ঝড়ে পড়া ও বিয়ের সংখ্যা বেশি। তাই রেজিস্ট্রেশন করানো হয়নি। তবে এখন জরিমানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে খরচ বেশি লাগবে। খরচ বেশি বললে তাদের বাবা আমাদের নামে মামলা দেয় কি না? ভয়ে আর বলা হয়নি।

লালমনিরহাট সিআইডি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) প্রাণকৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, আশামনি মুলত বাল্যবিয়ে শিকার হয়েছে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। আমরা মামলাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, আশামনির বাবার অভিযোগটি দ্রুত আমলে নিয়ে তাদের দুই বোনকে পুনরায় বিদ্যালয় মুখী করার ব্যবস্থা করা হবে। এ পরিবারের বিষয়টি গণশুনানীতে উঠেছিল। দুদক চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দশনা মোতাবেক তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

স্বাআলো/এস