রোগী বাড়ছে, কিট সংকট, মহামারী শঙ্কা

ভয়াল রূপে ফিরছে ডেঙ্গু ও করোনা

ঢাকা অফিস ঢাকা অফিস | June 14, 2025

দেশে ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাসের আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। উপসর্গ ভিন্ন হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন, যা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বিলম্ব ঘটাচ্ছে। এর মধ্যেই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষার কিট সংকট এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে, যা ভবিষ্যতে মহামারী আকার ধারণ করতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে চলতি বছরের শুক্রবার (১৪ জুন) পর্যন্ত ২৮ জন মারা গেছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৭০ জন। মশাবাহিত এ রোগে গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার) আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা চলতি বছর এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। একই সময়ে ১৫৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে চারজন বরিশাল বিভাগে এবং একজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ছিলেন।

এদিকে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণও বাড়ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে এবং নতুন করে ১৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

উপসর্গে পরিবর্তন, বাড়ছে বিভ্রান্তি:

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু ও করোনা ভাইরাস উভয়েরই আচরণ পরিবর্তিত হয়েছে। আগে ডেঙ্গু জ্বরে তীব্র জ্বর, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, কাশি ও গলা ব্যথা প্রধান উপসর্গ ছিল। কিন্তু এখন জ্বর তেমন তীব্র হচ্ছে না, গিঁটে ও গলায় ব্যথাও সামান্য থাকছে। তবে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা এবং জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা প্রধান উপসর্গ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কাশি থাকছে না।

যশোরে এক নারী করোনায় আক্রান্ত

একইভাবে, করোনার উপসর্গও বদলেছে। আগের মতো হাঁচি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা, তীব্র জ্বর—এসব এখন তেমন দেখা যাচ্ছে না। এখন জ্বর কম থাকছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টও হচ্ছে না, তবে মাথা ব্যথা বেশি হচ্ছে। বর্তমানে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মৌসুম হওয়ায় প্রচণ্ড মাথা ব্যথাকে অনেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা মনে করে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ঘরে বসে থাকছেন, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।

চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার সংকট:

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, যেহেতু রোগ দুটির আচরণ পরিবর্তন হয়েছে, তাই চিকিৎসার ধরনও পরিবর্তন করতে হবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়। সমস্যা হলো, পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত কিট নেই। দেশে টিকারও সংকট রয়েছে এবং করোনা প্রতিরোধে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল। বিশেষ করে এয়ারপোর্টে নমুনা সংগ্রহ তেমন হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও করোনার পরীক্ষার কিট সংকটের কথা স্বীকার করেছে। তারা বলছে, যত দ্রুত রোগ নির্ণয় হবে, তত দ্রুত আরোগ্য লাভ সম্ভব। তাই সারাদেশে চাহিদা অনুযায়ী কিট সরবরাহ করা জরুরি।

মহামারীর শঙ্কা ও করণীয়:

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে অনেক মানুষ মাথা ব্যথা ও গিঁটে গিঁটে ব্যথা নিয়ে জ্বর না থাকায় ঘরেই থাকছেন। যখন জটিলতা দেখা দেয়, তখন রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে এবং আইসিইউ প্রয়োজন হয়। কিন্তু আইসিইউ না পেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন। তাদের আশঙ্কা, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ডেঙ্গু ও করোনা মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। তাই এখনই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে নমুনা সংগ্রহের মতো সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

আবারো বাড়ছে করোনা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৭ জরুরি নির্দেশনা

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু ও করোনার আচরণে পরিবর্তন এলেও রোগ দুটি মোকাবিলার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে দ্রুত নমুনা সংগ্রহ ও রোগ নির্ণয় করতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা এবং মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দিনের বেলায় মোজা ও ফুল শার্ট পরার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, করোনা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে বয়স্ক রোগী, কিডনি রোগী, ক্যানসার রোগী ও অ্যাজমা রোগীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বেন। তাই এখনই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সাজাতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় থাকতে হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলমও ডেঙ্গু ও করোনার উপসর্গ পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং সামনে ব্যাপক হারে রোগী বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

বাড়ছে করোনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জরুরি নির্দেশনা

বেসরকারি হাসপাতালের ফি ও সচেতনতা:

চিকিৎসকরা সরকারি-বেসরকারি সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। তারা মনে করেন, বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষার নামে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গলাকাটা বাণিজ্য শুরু করেছে। বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিজেন টেস্টে ৭০০ টাকা এবং আরটি-পিসিআর টেস্টে ৩ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। যদিও সরকারি হাসপাতালে এই দুটি পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি হাসপাতালেও সামান্য ফি নির্ধারণ করে দিলে অযথা ভিড় কমবে এবং মানুষ সচেতন হবে।

শিশুদের সুরক্ষায় সতর্কতা:

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক শফি আহমেদ মোয়াজ শিশুদের ডেঙ্গু ও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি শিশুদের দিনের বেলায় ফুল হাতা পোশাক ও মোজা পরানো, সর্দি-কাশি-জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া এবং মাস্ক পরার পরামর্শ দেন। তিনি অভিভাবকদের ডেঙ্গু ও করোনার পরিবর্তিত লক্ষণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে এবং অবশ্যই মশারির মধ্যে ঘুমানোর আহ্বান জানান। শিশুদের রোদে না নেয়ার পরামর্শও দেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, গত বছর এ সময়ে করোনা আরো বেশি ছিলো। এখন আবার শুরু হয়েছে। জলাবদ্ধ এলাকা থেকে মশার বিস্তার ঘটছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন, সারাদেশে ডেঙ্গু ও করোনা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তবে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় না। তিনি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহবান জানান।

সব মিলিয়ে, ডেঙ্গু ও করোনার নতুন উপসর্গ, ক্রমবর্ধমান রোগী সংখ্যা এবং ব্যবস্থাপনাগত চ্যালেঞ্জগুলো সামনে রেখে স্বাস্থ্য খাতকে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

স্বাআলো/এস