খুলনা বিভাগ

যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল: রাতে ডাক্তার নেই, রোগীরা চরম ভোগান্তিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক | September 27, 2025

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রাতের বেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেখা মেলে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে রোগীরা উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, রাতে চিকিৎসকের ভূমিকায় থাকেন ইন্টার্ন, ওয়ার্ডবয়, আয়া ও ঝাড়ুদার। এমনকি শুক্রবারও কোনো কনসালটেন্ট বা সহকারী রেজিস্ট্রাররা হাসপাতালের দিকে নজর দেন না বলে জানা গেছে।

যশোর ছাড়াও নড়াইল, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার রোগীরা উন্নত চিকিৎসার আশায় এই হাসপাতালে আসেন। কিন্তু ভর্তির পর তারা প্রায়শই চিকিৎসা দুর্ভোগের শিকার হন। হাসপাতালে বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও রোগীদের ভাগ্যে তাদের চিকিৎসাসেবা ঠিকমতো জোটে না। তারা প্রতিদিন সকালে একবার করে ওয়ার্ড রাউন্ডে যান, তাও তড়িঘড়ি করে শেষ করেন। এতে অনেক রোগী তাদের রোগ নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। এই অনিয়মের কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে অনেকেই সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, যা চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য বাড়াতে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, ক্লিনিক বাণিজ্য জমজমাট করার জন্যই চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন।

রফিকুল ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন জানান, সকালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দল বেঁধে রাউন্ডে এলেও বেশি সময় রোগীর সঙ্গে কথা বলেন না এবং দ্রুত বেরিয়ে যান। সারাদিনে আর তাদের দেখা মেলে না, এমনকি রাতেও তারা ওয়ার্ড রাউন্ডে আসেন না। তিনি বলেন, তার রোগী পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে এক সপ্তাহের বেশি চিকিৎসাধীন থাকলেও এই সময়ে এক রাতেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফলোআপ চিকিৎসার জন্য রাউন্ডে আসেননি। রফিকুলের মতো একই অভিযোগ জানিয়েছেন রাসেল, বৃষ্টি, পারভীনা ও আশাদুল ইসলামসহ আরও অনেক রোগীর স্বজন।

গত কয়েকদিনে পুরুষ সার্জারী ওয়ার্ডে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, ছুরিকাহত, প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে ভর্তি হওয়া অনেক রোগীকে শুধুমাত্র ইন্টার্ন চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিচ্ছেন। রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হলেও সহকারী রেজিস্ট্রার বা বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক আসেন না। ইন্টার্নরা রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসা দেন, নতুবা নিয়মবহির্ভূতভাবে রোগীকে অন্যত্র রেফার্ড করে দেন। এই ওয়ার্ড থেকে গত এক সপ্তাহে ২২ রোগীকে খুলনা অথবা ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার যশোর শহরতলীর ঝুমঝুমপুর এলাকায় ছুরিকাহত সাকিবকে (১৯) রেফার্ড করা হয়। অথচ সরকারি এই হাসপাতালে সার্জারী ও অর্থোপেডিক বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ডিগ্রিধারী চিকিৎসক রয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ সেবিকা জানান, নিয়ম অনুযায়ী রোগী ভর্তির পর একজন ইন্টার্ন আসবেন। তিনি রোগীর অবস্থা দেখে অনকলে সহকারী রেজিস্ট্রারকে জানাবেন। সহকারী রেজিস্ট্রার রোগী দেখে অবস্থা খারাপ মনে করলে রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে ডাকবেন। কিন্তু বাস্তবে এই নিয়ম মানা হয় না, বরং তাদের অনুপস্থিতিতে সব দায়িত্ব ইন্টার্নদের উপর বর্তায়।

জানা গেছে, এখানে অনিয়মের বিশাল এক বাণিজ্য চলে। বিশেষজ্ঞরা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেম্বারে পকেট ভরতে ব্যস্ত থাকেন, আর সব দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় ইন্টার্নদের ওপর। ইন্টার্নদের ‘অনকল’ এখন ‘অন মোবাইল’-এ পরিণত হয়েছে। অনেক সময় ইন্টার্নরা মোবাইলে পরিস্থিতি জানানোর পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মোবাইলেই রোগীর জন্য চিকিৎসার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ফাইলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হাতের লেখায় এমন অসংখ্য নজির দেখা যায়। এজন্য ইন্টার্নরা ‘দিনভিত্তিক সম্মানী’ও পেয়ে থাকেন।

দেখা গেছে, হাসপাতালের কাটাছেঁড়া রোগী দেখলেই এগিয়ে আসেন ওয়ার্ডবয়, আয়া অথবা ঝাড়ুদার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সহকারী রেজিস্ট্রারদের অনুপস্থিতিতে তারা রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসা সামগ্রী কেনার শর্ট স্লিপ ধরিয়ে দেন। এরপর ইনজেকশন, সিরিঞ্জ, স্যালাইন, সুই-সুতা নিয়ে তারাই রোগীর চিকিৎসা করেন। এমনকি ক্যানোলা, ইউরিন ব্যাগ, খাদ্য গ্রহণের পাইপ লাগানোর কাজও তারা করেন। এতে তারা লাভবান হন, কেননা প্রতি রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে হাসপাতালের কর্মীরা অর্থবাণিজ্য করেন। সার্জারী, মেডিসিন, গাইনী ওয়ার্ডে অধিকাংশ সময় চিকিৎসকের ভূমিকায় ওয়ার্ডবয় ও ঝাড়ুদারকে দেখা যায়।

একাধিক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেছেন, জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা ছাড়া দিনের বেলায় কোনো চিকিৎসক রোগীর কাছে যান না। সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রায় নেই বললেই চলে। জরুরি মুহূর্তে রোগীর চিকিৎসায় ডাক্তার পাওয়া যায় না। কিছু সময় সিনিয়র সেবিকারাও রোগীর কাছে যান না এবং একবারের বেশি ডাকলে রুঢ় আচরণ করেন। তারাও শিক্ষানবিশ সেবিকাদের দিয়ে কাজ সারেন। সরকারি জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ও সেবিকারা যেন ফাঁকিবাজিতে ব্যস্ত।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়াত জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সহকারী রেজিস্ট্রারসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরেও কেউ রাতে ওয়ার্ড রাউন্ডে আসেন না বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। `

স্বাআলো/এস

Shadhin Alo