আন্তজাতিক ডেস্ক: ঐতিহাসিকভাবে রমজান মাসটি গাজার ২২ লাখ মুসলিমের জন্য আনন্দদায়ক সামাজিক সমাবেশ, আধ্যাত্মিক প্রতিফলন, বিশ্বাসের পুনর্নবীকরণ এবং লালিত পারিবারিক পুনর্মিলনের সময়। তবে গত এক দশক ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসন-যুদ্ধ একসময়ের এই প্রাণবন্ত ঐতিহ্যের ওপর কালো ছায়া ফেলেছে।
চলমান গণহত্যামূলক হামলা এখনো পর্যন্ত ৩২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, গাজাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই হামলা পবিত্রতম মাসটিকে সবচেয়ে বিধ্বংসী করে তুলেছে।
রাস্তায় পথচারীদের দেখা পেলেও ‘রমজানুল কারিম’ বলে বিনয়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা জানাতে পারি না। এই ধরনের শুভেচ্ছা এখন অনুপযুক্ত এবং প্রায় লজ্জাজনক বলে মনে হয়! কারণ রমজানের সমস্ত আনন্দ উদযাপনের জায়গা নিয়েছে নীরব শোক। কেবল যুদ্ধ, দুঃখ ও কষ্টের প্রতিধ্বনি!
গত বছর, আমি আমার ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো একটি ভালো বেতনের চাকরি সুরক্ষিত করতে পেরে আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি আমার ২২ জন ভাগনি ও ভাগনের ভাগ্নের প্রত্যেককে একটি রঙিন লণ্ঠন বা ‘ফানুস’ দিয়ে পবিত্র মাসটি শুরু করার জন্য তাদের অবাক করে দিয়েছিলাম।
তাদের আনন্দ ছিলো সংক্রামক! আমি এই উপহারের সঙ্গে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আমি জানতাম না যে, আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা পরিস্থিতিগুলো আনন্দের এই প্রতিজ্ঞাকে নির্মমভাবে চূর্ণ করে দেবে।
বর্তমানে গাজার বাস্তব জীবন আমূল বদলে গেছে। আমার অনেক ভাতিজি ও ভাতিজা তাঁবুতে বাস করছে। ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছে এবং যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। অন্যরা গাজা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
পবিত্র মাসকে স্বাগত জানাতে গাজার পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বারান্দা ও দোকানের সামনের অংশে লণ্ঠন দিয়ে সজ্জিত করে। গাজার রাস্তাগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমার মনে আছে, আমার ভাবিরা আমাকে এই ছোট ছোট লণ্ঠন দিয়ে আমাদের বাড়ির বারান্দা সাজাতে সাহায্য করেছিল।
তরুণ-তরুণী-যুবকদের নেতৃত্বে এই লালিত ঐতিহ্য পুরো পাড়ায় একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি করেছিলো। জেনারেটর, সৌর প্যানেল, এমনকি বিক্ষিপ্ত বিদ্যুতে চালিত গাজার আলোকিত রাস্তাগুলো আমার হৃদয়কে আনন্দে ভরিয়ে তুলতো। কিন্তু এ বছর রমজান একটি শোকের মাস!
গাজার প্রাণবন্ত রাত্রিকালীন রাস্তাগুলো বিষণ্ণ নীরবতায় ডুবে গেছে। এক সময় যেখানে প্রাণ ছিলো, সেখানে এখন ধ্বংসস্তূপ। শিশুদের খেলার আনন্দময় শব্দগুলো কেড়ে নিয়েছে ধংসস্তুপের নিচে আটকে পড়াদের হৃদয়বিদারক কান্না।
রমজানের প্রথম দিনে অতীতের কিছু আভাসের খোঁজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। পরিবর্তে আমার যে ক্ষীণ আশা ছিলো, সে আশাও যে আমরা কতটা হারিয়ে ফেলেছি-তার বেদনাদায়ক উপলব্ধি হয়। মাত্র কয়েকটি স্টল রয়ে গেছে যা প্রাণবন্ত বহিরঙ্গন বাজার হিসাবে ব্যবহৃত হতো। অল্প পরিমাণে লেবু, বেগুন, টমেটো ও ঘরে তৈরি লন্ড্রি সাবান সরবরাহ করে এখন। আমি যে মুখগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলাম-সবই দুঃখ ও হতাশায় ভরা ছিলো। সেই মুহূর্তে, আমি সেই লালিত স্মৃতিগুলো হারানোর জন্য নিজেকে কাঁদতে সাহায্য করতে পারিনি।
একদা রঙিন আলো আর লণ্ঠন রাস্তায় শোভা পেত, তার জায়গা নিয়েছে বোমার প্রচণ্ড ঝলকানি আর চরম ধ্বংসযজ্ঞ। একসময় মুসল্লিদের ভিড়ে ঠাসা মসজিদগুলো হয় খালি পড়ে আছে, নয়তো ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। ইমামরা এখন মানুষদের তাদের নিজস্ব বাড়ি বা অস্থায়ী তাঁবুর সীমানার মধ্যে ইবাদত করার পরামর্শ দেন।
এখন মসজিদে তারাবিহ নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতে ভরা রমজানের রাতের পরিবেশ বদলে নিয়েছে ইসরাইলি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। গাজার রাস্তাঘাট ও দোকানপাটে যে সুগন্ধ ছড়িয়ে থাকতো, তা এখন দূরের স্মৃতি। আল-জাওয়ায়ার মতো গাজার প্রাচীনতম জমজমাট বাজারগুলোতে বালতি বালতি টক আচার, জলপাই, বিভিন্ন খেজুরের কার্টন, মশলার স্তূপ, শুকনো ফল, জ্যাম ও অন্যান্য রঙিন খাদ্যসামগ্রী মজুদ থাকতো। সব এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
রমজানের প্রথম দিন যখন আসতো ইফতারের জন্য কী রান্না করবো- তা আমাদের কখনো ভাবতে হয়নি। কারণ উত্তর ছিলো স্পষ্ট- ‘মলোখিয়া’। পাট ম্যালো গাছের পাতা থেকে তৈরি এই ঘন এবং স্বাদযুক্ত স্টু সর্বদা গাজার রমজানের খাবারের জন্য ঐতিহ্যবাহী ‘ওপেনার’ হিসাবে কাজ করেছিলো। অন্যান্য ফিলিস্তিনি মা ও দাদীদের মতো আমার মা বিশ্বাস করতেন যে, ‘মোলোখিয়া’র প্রাণবন্ত সবুজ রঙ আশাবাদ জাগিয়ে তোলে এবং সৌভাগ্য বয়ে আনে। তবে এ বছরটা অন্যরকম। খাবারের ক্ষেত্রে আমাদের আর পছন্দের বিলাসিতা নেই। পরিবর্তে, আমরা বিভিন্নভাবে আসা সহায়তা পার্সেলগুলোতে পাওয়া প্রাপ্ত খাবারের কয়েকটি ক্যানের উপর নির্ভর করি।
যদিও বিশ্বজুড়ে রোজা রাখা বেশিরভাগ লোক খাদ্য এবং ক্যাফিনের অভাব থেকে মাথাব্যথা ও ক্লান্তি অনুভব করতে পারে। এই বছর আমরা রমজানের সেই প্রথম দিন থেকে ক্লান্তি অনুভব করিনি, কারণ আমরা ইতিমধ্যে কয়েক মাস ধরে খাদ্য বঞ্চনা এবং মৌলিক প্রয়োজনীয়তার অভাব সহ্য করেছি।
আজ গাজার নাগরিকরা রোজা রাখে কোনো ইচ্ছার জন্য নয় বরং তাদের খাদ্য ও পানির অভাবের কারণে! আমার ভাই (একটা হাসপাতালে কাজ করে), সে বলেছিলো- ‘আমরা পাঁচ মাস ধরে রোজা রাখছি, তাই প্রথম দিন মাথা ব্যথা হবে কিনা জানি না।’
আমাদের প্রথম সেহরির সাথে ছিলো দেইর আল-বালাহ অঞ্চলে ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং আর্টিলারি গোলাবর্ষণ। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘রমজান মাসেও!’
আমরা রমজানের জনপ্রিয় মিষ্টি কাতায়েফের সঙ্গে আপ্যায়ন করতাম, যা এখন আর পাওয়া যায় না। এক কেজি চিনি আগে মাত্র আট এনআইএস (দুই ডলার) দামি ছিলো, এখন একটি বিস্ময়করভাবে ৮৫ এনআইএস (বা ২৩ ডলার সমপরিমাণ)।
গাজায় রমজানে বড় বড় ভোজ হতো। অনেক লোক একসঙ্গে হয়ে খাবার খেতো। এখন পরিবারগুলো আর উৎসবের জন্য নয়, জড়ো হয় শোকে। ঘরবাড়ি, বাজার, স্কুল ধ্বংস ও প্রিয়জন হারানো এবং দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হওয়ার ফলে আমরা অকল্পনীয় যন্ত্রণা ও ক্ষতির সঙ্গে লড়াই করছি।
পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে গণহত্যা, রোগ, অনাহার, বাস্তুচ্যুতি, বহিষ্কার এবং তৃষ্ণা সহ্য করেছে গাজা। আমি রমজানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম এই আশায় যে, এই পবিত্র মাসটি আগের থেকে ভিন্ন হবে। তবে রমজানের আগমনে সহিংসতা ও নৃশংসতা থামছে না বা কমেনি।
আমরা প্রার্থনা করতাম-যেন রমজানে অন্তত আমরা আমাদের কোনো প্রিয়জনকে না হারাই। কিন্তু এই রমজানে আমরা হারিয়েছি অসংখ্য বন্ধু, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে। আমরা ঘরবাড়ি হারিয়েছি। আমরা আমাদের জীবন হারিয়েছি। আমরা স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সব হারিয়েছি। পবিত্র এই মাসে আমরা সবকিছু থেকেই উপবাসে আছি-সেটি হতে পারে খাবার, কথা বলা, হাসি কিংবা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা…। কেবলি দুঃখ আর হতাশার প্রাচুর্য।
স্বাআলো/এস