সম্পাদকীয়: যশোর শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এককালের প্রমত্তা ভৈরব এখন ভরাট হয়ে এক হাজামজা খালে পরিণত হয়েছে। সব চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নওয়াপাড়া নদী বন্দরে। সেখানে পলি পড়ে জাহাজ আসার অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। নদী দখল করে জাহাজ ভেড়নোর বহু সংখ্যক ঘাট তৈরি করায় নদীর ভরাট তরান্বিত হচ্ছে।
আর এ কারণে ২০ হাজার শ্রমিক কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। ২২৫ বছর আগে থেকে ভৈরবের মৃত্যু ঘন্টা বাজে। ওই সময় দর্শনায় এ নদে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে মাথাভাঙা নদে নেয়া হয়। এতে নদের মাথায় পানির চাপ না থাকায় জোয়ারের সময় আসা পলি থিতিয়ে নদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে নদটি মরা খালে পরিণত হয়।
যশোরবাসীর যদি স্মৃতি বিভ্রাট না ঘটে তাহলে সবার স্মরণ থাকার কথা এই ভৈরব খনন করে যশোর শহরের প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার গান আমরা কম শুনিনি।
যশোরে সব মহলে একটি কথা চালু রয়েছে যে, এ জেলা উন্নয়ন কাজে দেশের যে কোনো জেলার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এ জন্য অনেকে নেতৃত্বের যোগ্যতার বিষযটা সামনে আনার চেষ্টা করে। আমরা মনে করি এখানে আইনী জটিলতা রয়েছে। যে দখলদারদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা নিশ্চয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর। আর সেই সূত্রে কুটিল বুদ্ধিও রাখে। নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তারা গণমানুষের স্বার্থ পদদলিত করতে মোটেও দ্বিধা করে না। তারা কোনো সময় পরিবেশ, কোনো সময় ঐতিহ্য, কোনো সময় মানবাধিকার প্রভৃতি বাহানা তুলে সব কাজে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। এরা নানা ছদ্মাবরণে এ সব বাহানা তোলে। দখলদাররা যত প্রভাবশালী হোক না কেনো তারা তো আর কোনো ভালো কাজ করে বসে নেই। তাহলে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো যুক্তি, কোনো মানবিকতা কিছুই থাকা উচিত নয় বলে মনে করি। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
পবিত্র ঈদুল আযহা মানুষ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই হজরত ইবরাহীম (আ.) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। ঈদুল আযহার মূল আহবান হলো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মহববত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি আত্মসমর্পণ করাই হলো ঈদুল আযহার মূল শিক্ষা। আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও আল্লাহকে খুশী করার জন্য তাঁর হুকুম মোতাবেক জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে যবেহ করার কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণ-এসবই ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট আনুগত্য, গভীর আল্লাহভীতি এবং নিজের তাওহীদ ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর হুকুমে পুত্র কুরবানী করেছিলেন। মূলতঃ তিনি এর দ্বারা পুত্রের মহববতকে কুরবানী করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর আচরণে। আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। আর এটাই হলো প্রকৃত তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। প্রতি বছর জিলহজ মাসে মুসলিম জাতি পশু কুরবানীর মাধ্যমে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি স্মরণ করে এবং পশু কুরবানীর সাথে সাথে নিজেদের পশুবৃত্তিকে কুরবানী দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। ইসমাঈল নবীন বয়সেই বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণের এক বাস্তব ও জ্বলন্ত শিক্ষা প্রদান করেন। মূলতঃ আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার নামই হলো আত্মসমর্পণ। পিতা-পুত্র আল্লাহর প্রতি
পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা যেমন অতুলনীয়, তেমনি চির অনুকরণীয়। পশু কুরবানীর সাথে সাথে আমাদের দৃপ্ত শপথ নিতে হবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জান, মালসহ যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত আছি।
ঘোষিত মানবজাতির ইমাম। তিনি মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তাদের জন্যে ইবরাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’।
কুরবানী কেবল পশু কুরবানী নয়। নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের কুরবানী। নিজের সালাত, কুরবানী, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কুরবানী।
মুসলিম পরিবারের প্রতিটি মানুষেরই একমাত্র আদর্শ হবে আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণ করা। তাই কুরবানীর পশুর গলায় ছুরি দেয়ার আগে নিজেদের মধ্যে লুক্কায়িত পশুত্বের গলায় ছুরি দিতে হবে। মহান আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ও আত্মত্যাগী হতে হবে। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন বা মুত্তাকী হতে হবে। আমাদের সালাত, কুরবানী, জীবন-মরণ সবকিছু আল্লাহর জন্যই উৎসর্গ হোক, ঈদুল আযহায় আল্লাহর এই আমাদের প্রার্থনা।
স্বাআলো/এস/বি