বাগেরহাটে সিজার অপারেশনে প্রসূতির মৃত্যু, বন্ধ হাসপাতাল

আজাদুল হক, বাগেরহাট আজাদুল হক, বাগেরহাট | May 28, 2025

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফয়লা বাজারে অবস্থিত সুন্দরবন (প্রাঃ) হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিজার অপারেশন করতে গিয়ে তানিয়া বেগম (২০) নামের এক প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, এনেসথিয়া ব্যবস্থা ছাড়াই ভাড়ায় আনা চিকিৎসক দিয়ে সোমবার রাতে এই অপারেশন করা হয়েছিলো। অপারেশনের এক ঘন্টার মধ্যেই প্রসূতি মারা যান।

এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে মঙ্গলবার বেসরকারি হাসপাতাল নামের এই প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করেন রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুকান্ত কুমার পাল। পরিদর্শনের পর তিনি তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালটির অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।

ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, রামপাল উপজেলার ছোট নবাবপুর গ্রামের ফেরদৌসের স্ত্রী তানিয়া বেগমকে সিজারিয়ানের জন্য মৌখিক চুক্তিতে সুন্দরবন হাসপাতালে দুই দিন আগে ভর্তি করা হয়। সোমবার রাত ৯টায় প্রসূতিকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ভাড়ায় আনা একজন চিকিৎসক দিয়ে অপারেশন শুরু করা হয়। ভুল অপারেশনের ফলে অপারেশন থিয়েটারের মধ্যেই রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তড়িঘড়ি করে হাসপাতালের লোকজন তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে রেফার করে। সেখানে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তানিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাগেরহাটে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন

এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার আগেই সুন্দরবন হাসপাতালের পরিচালক নাজমুল হাসান রিয়াজ নিহত প্রসূতির স্বজনদের সাথে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিষয়টি দফারফা করার চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ ওঠে।

নিহত প্রসূতির স্বজনরা জানান, তারা গ্রামের সহজ সরল মানুষ। কম খরচে তানিয়ার সন্তান প্রসবের জন্য তারা ওই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। দুই দিন আগে ভর্তি করার পর সোমবার রাতে তাকে সিজারের জন্য অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় এবং এরপরই এই ঘটনা ঘটে। তারা ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দাবি করেছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পরিদর্শন অনুযায়ী, সুন্দরবন হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত নিয়ম-নীতির চরম লঙ্ঘন দেখা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত ২২ ফেব্রুয়ারীর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যে কোনো অপারেশনে সার্জনের সহকারী হিসেবে অবশ্যই একজন এমবিবিএস ডাক্তার থাকতে হবে। ১০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে তিনজন নিবন্ধিত মেডিকেল অফিসার ও স্বীকৃত ডিগ্রিধারী এনেস্থেসিয়া চিকিৎসক থাকতে হবে। অথচ সুন্দরবন হাসপাতালে কোনো ডিউটি ডাক্তার ছিল না, সার্জনের সহকারী হিসেবে কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না এবং অপারেশনের জন্য স্বীকৃত এনেস্থেসিয়া চিকিৎসকও ছিলেন না।

এছাড়া, অপারেশন থিয়েটারে মনিটরিং সিস্টেম, ব্লাড প্রেসার মেশিন, পালস অক্সিমিটার বা অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর-এর মতো অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি ছিল না। পরিদর্শনে ওটিতে এনেস্থেসিয়া যন্ত্রপাতি অকেজো ও বিকল অবস্থায় পাওয়া যায়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কোনো এনেস্থেসিয়া চিকিৎসক ছাড়াই এবং অকার্যকর যন্ত্র দিয়ে রোগীকে অপারেশন করা হয়েছে। ইমার্জেন্সি সেবা চালু না থাকায় রোগীকে অনেক সময় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়।

রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুকান্ত কুমার পাল জানান, একজন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু খুবই হৃদয় বিদারক। হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে ক্লিনিক চালানোর মতো সরকার নির্ধারিত কোনো প্রকার উপযোগী যন্ত্রপাতি নেই। অপারেশন চলাকালীন তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কেউ ছিলো না। পরিদর্শনে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। যে কারণে ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করা হলো। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে ওই হাসপাতালে গিয়ে দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গতঃ অভিযোগ রয়েছে যে, ওই হাসপাতালে এর আগেও একাধিক প্রসূতি মায়ের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কতিপয় প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাবাদীদের ম্যানেজ করে তাদের ব্যবসা ধরে রেখেছে।

স্বাআলো/এস