জাতীয়

‘মব ভায়োলেন্স’ থামানো যাচ্ছে না কেনো

ঢাকা অফিস ঢাকা অফিস | July 11, 2025

সম্প্রতি বাংলাদেশে একের পর এক ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির ঘটনায় জনমনে তীব্র আতঙ্ক ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মত দিয়েছেন।

দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে (এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন) অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের দশ মাসে মব ভায়োলেন্সে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৪ জনে। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। যদিও সরকার পক্ষ মবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে, তবুও কেন এই দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা থামানো যাচ্ছে না—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দেশের রাজনীতিতে মব ইস্যুটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা বা ‘ন্যারেটিভ’ বিদ্যমান। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এই ঘটনাগুলোকে ‘জনরোষ’ হিসেবে দেখছে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেসার’ হিসেবে উল্লেখ করে একটি ব্যাখ্যা দেন, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিগত সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই কিছু ঘটনা ঘটছে।

অন্যদিকে, ভিন্নমত পোষণকারী রাজনীতিকদের অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের গত ১১ মাসের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অথবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলেই মবের জবরদস্তি দেখা যাচ্ছে। তবে বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং গত বছরের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের একাংশের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির বিরুদ্ধেও মবের অনেক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

রাজনীতিতে মব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা বা বক্তব্য যাই থাকুক না কেন, এই পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, সে বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত নেই। মব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে বলেও কোনো কোনো রাজনীতিক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

কারা ঘটাচ্ছে মবের ঘটনা?

মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ বছরের প্রথম ছয় মাসের ঘটনা বিশ্লেষণ করে বলছে, কখনো রাজনৈতিক, কখনো গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে কাউকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বা এ ধরনের ‘তকমা’ দিয়ে মব ভায়োলেন্স সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, কট্টরপন্থি ধর্মভিত্তিক কিছু গোষ্ঠী, যাদের রাজনীতিতে বা সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন জোরালো অবস্থান নেই, এ ধরনের কিছু শক্তি ‘তৌহিদী জনতা’ বা এ ধরনের ব্যানারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু মব তৈরি করেছে। ইসলামপন্থি কোনো কোনো দলেরও এতে সমর্থন ছিলো।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোনো শক্তি একের পর এক মব তৈরি করে দেশকে একটা পরিস্থিতির দিকে নিতে চাইছে, যাতে পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মব ভায়োলেন্সের ঘটনাগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে এনসিপির বিরুদ্ধেই অভিযোগের পাল্লা বেশি ভারি। যদিও দলটি এই অভিযোগ অস্বীকার করে মবের ঘটনাগুলোকে ‘জনরোষ’ বা ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছে।

এনসিপির নেতাকর্মীদের মবের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সর্বশেষ একটি অভিযোগ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের পটিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছে। একজন মানবাধিকার কর্মী ঘটনাটিকে ‘বিস্ময়কর’ বলে উল্লেখ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু নেতাকর্মী মব তৈরি করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের একজন কর্মীকে ধরে পটিয়া থানায় নিয়ে যায় এবং তাকে গ্রেফতারের দাবি জানায়। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ গ্রেফতার করতে অপারগতা জানালে এনসিপি ও ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে বিতণ্ডা ও সংঘর্ষে জড়ায়। পরে তারা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপসারণ দাবি করে এবং সেই দাবির মুখে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়।

গত বছরের পাঁচই আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন আলোচিত বেশ কিছু ঘটনায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও কয়েকটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মব তৈরিতে ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। তবে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরও মবের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

বিএনপির বিরুদ্ধেও মব ভায়োলেন্সে সংশ্লিষ্টতার অনেক অভিযোগ আলোচনায় এসেছে। গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়ার আগে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়। সেই মবের ঘটনায় বিএনপির একদল নেতাকর্মীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি ঢাকার মহাখালীতে যুবদলের স্থানীয় একজন নেতার সমর্থকেরা সেখানকার একটি রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় এবং একজন নারীকে মারধর করে। সেই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে যুবদলের ওই নেতাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসিকে বলেন, তার দল মবের মতো কর্মকাণ্ডকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিচ্ছে না। তিনি জানান, গত ১০ মাসে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর চার হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দলের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরও বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকে ব্যক্তি স্বার্থ ও প্রতিহিংসা থেকে দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

সাতদিনেই মব ভায়োলেন্সে নিহত পাঁচ

আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মবের চারটি ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৩ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরের একটি গ্রামে নারীসহ একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানের কাছাকাছি।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলছেন, মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দেশে এর আগেও গণপিটুনি বা মবের ঘটনা ঘটলেও গত বছরের আগস্টে গণ অভ্যুত্থানের পর রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত একের পর এক মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং তা থামছে না।

কেনো থামছে না মব ভায়োলেন্স?

মবের ঘটনা না থামার পেছনে বড় অভিযোগ হচ্ছে, সরকার সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে যখন ‘বুলডোজার মিছিলের’ ডাক দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় দুদিন ধরে ভাঙচুর করা হয়, তখন সরকারের নীরবতা লক্ষণীয় ছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেহেতু সরকারের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না, সেহেতু তাদের এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে, এমন ধারণা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকার না চাইলে মবের ঘটনা ঘটতে পারে না।” তিনি আরো মনে করেন, “রিজিম পরিবর্তনের পর যার যার স্বার্থ থেকে মব ভায়োলেন্সের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর পেছনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তাও থাকতে পারে।”

অন্যদিকে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও মব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, গণ অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এবং পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো সম্ভব হয়নি, যা মব না থামার অন্যতম কারণ।

জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, “গত সাড়ে পনেরো বছরে যারা অপরাধ করেছেন, সরকার তাদের সঠিকভাবে আইনের আওতায় আনতে পারেনি। সে কারণে সে সময় নির্যাতিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে অনেক ক্ষেত্রে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবের বক্তব্যও প্রায় একইরকম। তিনি বলেন, “একক কোনো গোষ্ঠী মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে না। অনেক মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে, স্থানীয়ভাবে অনেকের মধ্যে বিদ্বেষ আছে, এর থেকেও মবের ঘটনা ঘটছে।”

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, প্রতিহিংসা থেকেই মব ভায়োলেন্সের বেশিরভাগ ঘটনা ঘটছে এবং কোনো কোনো পক্ষ যখন এসবের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। রাজনৈতিক দল, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ মবের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলেও তারা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে—সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

স্বাআলো/এস

Shadhin Alo