বাগেরহাটে পরবর্তী সহিংসতায় দেড় শতাধিক কর্মী-সমর্থক আহত

| June 12, 2024

আজাদুল হক, বাগেরহাট: সদ্য শেষ হওয়া ৬ষ্ট উপজেলা পরিষদ নির্বাচন -২০২৪ এর শেষ ধাপে বাগেরহাটের তিন উপজেলার নির্বাচন পরবর্ত্তি সহিংসতায় দেড় শতাধিক আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। গত ৯ জুন নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা ও মোংলা উপজেলায় এ সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ সময়ে পরাজিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গচুর ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন শেষে অনেকে বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ।

রবিবার রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত ৩ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতায় সব থেকে বেশি আহত হয়েছেন মোরেলগঞ্জ উপজেলার বাসিন্ধারা। এ উপজেলায় বিজয়ী প্রার্থীর কর্মী- সমর্থকদের হামলায় পরাজিত প্রার্থীর শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আহতদের মধ্যে ৮জন কে মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেকক্সে ভর্তি করা হয়েছে। কেউ কেউ শরণখোলা
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেকক্স ও পিরোজপুর সদর হাসপাতালেও চিকিৎসা নিয়েছেন। মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেকক্সে চিকিৎসাধন মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর সুতালরি এলাকায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুয়াল হোসেন জোয়াদ্দার বলেন, দোয়াত কলম প্রতিকের কেন্দ্র সমন্বয়ক থাকার কারণে নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে বিজয়ী প্রার্থীর লোকজন রাস্তার উপর ফেলে আমাকে মারধর করে। বৃদ্ধ বয়সে কখনও আশা করিনি, এমন হামলার শিকার হব। যারা হামলা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাহ জামাল তালুকদার বলেন, বুঝ হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। সরকারি দলের দুইজন প্রার্থী ছিলেন, একজনের পক্ষে কাজ করায়, আজ আমি হাসপাতালে। শুধু আমি নয়, এলাকার অনেক নেতাকর্মীকে এভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আর কেউ যেন, নির্যাতনের শিকার না হয় এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। এদিকে বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা থেকে বাঁচতে মোরেলগঞ্জ উপজেলার খাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে আশ্রয় নিয়েছে অধর্-শতাধিক নারী পুরুষ। পরিষদে আশ্রয় নেয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মোজাম্মেল হক মোজামের ভোট কেন্দ্রের এজেন্ট নুপুর আক্তার বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান বাজার ভোট কেন্দ্রে দোয়াত কলম প্রতিকের এজেন্ট ছিলাম। ভোটে আমাদের প্রার্থী হেরে যায়। ভোটের দিন বিকেলেই খাউলিয়া এলাকার দেলোয়ার খলিফা ও রানা শিকদার আমাকে হুমকি দেয়। পরের দিন সকালে খাউলিয়া বাজারে থাকা আমার বাবার সাইকেল-ভ্যানের গ্যারেজ বন্ধ করে দিয়েছে।

আমাকে মারধর ও রাস্তায় অপমান করবে বলে হুমকি দিয়েছে। এই অবস্থায় মান সম্মান বাঁচাতে ইউনিয়ন পরিষদে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আমরা জীবনের নিরাপত্তা চাই। খাউলিয়া ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সাবেক ইউপি সদস্য শাহনাজ বেগম বলেন, ভোটের পরে এলাকায় যা ইচ্ছে তাই করছে দেলোয়ার খলিফা ও রানা শিকদার। অনেককে মারধর করেছে। আমার কাছে টাকা চেয়েছে, মারধরেরও হুমকি দিয়েছে।
কারও কারও দোকান পাট বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকের সাথে আমিও পরিষদে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আওয়ামী লীগ করেও যদি এই ধরণের নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব? দেলোয়ার খলিফা ও রানা শিকদারের লোকজনের মারধরে মাথা ফেটেছে খাউলিয়া ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুণ অর রশীদের। তিনিও বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন খাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে। তিনি বলেন, অপরাধ শুধু
দোয়াত কলম প্রতিকের এজেন্ট ছিলাম। এ জন্য আমাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। এলাকার অনেকেই এখন বাড়ি ছাড়া। আমরা এই রাজনীতি চাই না। খাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাস্টারসাইদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়-ই দল থেকে একাধিক প্রার্থী হয়েছেন। কর্মীরা যার যার পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে।

আমরাও দোয়াত কলম প্রতিকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছি। কিন্তু আনারস প্রতিকের প্রার্থী বিজয় লাভ করায়, তার সমর্থকরা এলাকার লোকজনের উপর অমানুষিক অত্যাচার করছে। সম্মান ও প্রাণ বাঁচাতে অনেক লোক ইউনিয়ন পরিষদের এসে আশ্রয় নিয়েছে। অতিদ্রুত এই অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানান এই জনপ্রতিনিধি। মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শর্মী রায় বলেন, গেল দুই দিনে আহত অবস্থায় ৮জন রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। আমরা তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করেছি। পরাজিত প্রার্থী দোয়াত কলম প্রতিকের মোজাম্মেল হক মোজাম বলেন, নির্বাচনের আগে ও পরে আমার কর্মী-সমর্থকদের উপর যে নির্যাতন হচ্ছে তা ভাষায় বর্ননা করা যায়। দুই দিনে আমার শতাধিক নেতা-কর্মী ও সমর্থক আহত হয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও লুটপাট করেছে তারা। আমি যদি নির্বাচন করে ভুল করি, তাহলে আমাকে মারধর করুক।

তবু আমার কর্মী-সমর্থকদের উপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করুক। চলমান সহিংসতা বন্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই নেতা। নব নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী খান বলেন, সবাইকে শান্ত থাকতে বলা হয়েছে। কোন প্রকার বড় সহিংসতার খবর পাইনি। নির্বাচনের ইস্যু নিয়ে অনেকে আবার ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে এই সময়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। কোথাও কোন সমস্যা না হয় এজন্য সবাইকে বলা হচ্ছে। অপরদিকে শরনখোলা উপজেলায় নির্বাচনের পরে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী প্রার্থী রায়হান উদ্দিন আকন শান্তর সমর্থকদের হামলায় পরাজিত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আছাদুজ্জামান মিলনের কমপক্ষে ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে
অভিযোগ করেন। তারা শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচনের পরে মোংলা উপজেলার বিজয়ী প্রার্থী আবু তাহের হাওলাদারের কর্মী- সমর্থকদের বিরুদ্ধে পরাজিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মারধর ও অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে। এ উপজেলায় কমপক্ষে ২৫ জন কর্মী- সমর্থক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি পিযুষ কান্তি মজুমদারসহ ৮জনকে গুরুতর অবস্থায় মোংলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রতিবাদে সোমবার দুপুরে মোংলা পোর্ট পৌরসভার সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে পূজা উদযাপন পরিষদ ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এ বিষয়ে বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এ্যান্ড অপস) রাসেলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন পরবর্তী তিন উপজেলায় কিছু ছোট-খাটো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তাৎক্ষনিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। বড় ধরণের সহিংসতা এড়াতে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

স্বাআলো/এস/বি