ঢাকা অফিস: দেশে গত ৯ বছরে শনাক্ত যক্ষ্মা (টিবি) রোগী ৩০.৫৫ শতাংশ বেড়েছে। শনাক্তের বাইরে রয়েছে অন্তত ২০ শতাংশ রোগী। শনাক্তদের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার নমুনা পাওয়া যাচ্ছে ১ শতাংশ রোগীর দেহে। এ নিয়ে নতুন করে চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য মতে, ২০১৫ সালে শনাক্ত রোগী ছিলো দুই লাখ ৯ হাজার ৪৩৮ জন। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ এক হাজার ৫৬৪ জনে; এর মধ্যে দুই হাজার ৪৩৭ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ পুরুষ ও ৪২ শতাংশ নারী। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর) রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৭২৯।
সরকারি হিসাবে, ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু হয়েছিলো প্রতি লাখে ৪৫ জনের। ২০২৩ সালে সেটি কমে হয়েছে ২৫ জন। সে হিসাবে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৪২ শতাংশ কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শনাক্তের বাইরে থাকা রোগী কিংবা যারা চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ করে না তাদের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা নতুন উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার চিকিৎসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার গাইডলাইন অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি (ছয় মাস) ওষুধ খাওয়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ রবিবার (২৪ মার্চ) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইডিসিএইচ), শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘হ্যাঁ! আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি’।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গতকাল শনিবার কথা হয় যক্ষ্মায় আক্রান্ত বাবুল মিয়ার সঙ্গে।
তিনি ভর্তি আছেন হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাত নম্বর বিছানায়। তিনি জানান, শুরুটা সাধারণ যক্ষ্মা দিয়ে হলেও লম্বা চিকিৎসা নেন বুকে ব্যথার। যখন রোগ শনাক্ত হলো, তত দিনে ফুসফুসে কফ জমেছে, রক্তও যায় মাঝেমধ্যে।
বাবুল মিয়া বলেন, গাজীপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়ে সাড়ে তিন মাস ওষুধ খেয়েছিলেন। ভালো না হয়ায় ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে আসেন। সেখানে ৯ মাসের চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে তিনি নিয়মিত ওষুধ সেবন করেননি।
চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ছয় মাস নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়মিত ও পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ না খেলে যক্ষ্মার জীবাণু ওই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের অবহেলা ও অসচেতনতায় এই ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর টিবি বাড়ছে, যাদের একটা বড় অংশই মারা যায়।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক আবাসিক চিকিৎসক ডা. সেরাজুল ইসলাম বলেন, ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্তরা যে জীবাণু ছড়ায়, তা-ও ওষুধ প্রতিরোধী। তবে শনাক্তের পর নিয়মিত, পরিমিত ও পূর্ণ মেয়াদের চিকিৎসা নিলে এ রোগ ভালো হয়। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন সচেতন হয়া।
ডা. সেরাজুল ইসলাম বলেন, এলাকাভিত্তিক পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে নেই। তবে সাধারণত যেসব এলাকা দরিদ্র, খাদ্যে পুষ্টিমান কম, জীবনযাত্রার মান খারাপ, তাদের যক্ষ্মা কিছুটা বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে একই সঙ্গে অনেক লোক বসবাস করে তেমন মানুষ বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই রুমে যখন চার-পাঁচজন থাকে এবং তাদের মধ্যে কারো যদি সুপ্ত যক্ষ্মা হয়, তাহলে তার কাছ থেকে বাকিরাও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়।
তিনি বলেন, ‘টিবি হাসপাতালে সারা দেশ থেকেই আসা রোগী আছে। এর মধ্যে কিছু রোগী রেফার্ড হয়ে আমাদের এখানে আসে; যাদের টিবি শনাক্ত হয়ার পর চিকিৎসা হয়েছে কিন্তু টিবি ভালো হচ্ছে না তেমন রোগী এবং টিবির সঙ্গে অন্য রোগে আক্রান্ত তারা আসে। যেমন- টিবির ওষুধ খেলে হেপাটাইটিস না হয় জন্ডিস দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা নিয়ে রোগীরা আমাদের কাছে আসে। এর বাইরে এমডিআর, অর্থাৎ যাদের কোনো ওষুধই কাজ করছে না তারাও আমাদের কাছে আসে।’
ডা. সেরাজুল ইসলাম জানান, নিয়মিত ওষুধ না খাওয়ার কারণে যক্ষ্মা রোগীরা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যায়। এমন রোগী প্রথম দিকে পায়া যেতো। এখন ওষুধ খায়নি এমন রোগীও ওষুধ প্রতিরোধী টিবিতে আক্রান্ত হচ্ছে, যাকে প্রাইমারি এমডিআর বলে। তারা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা, দেশে যতো টিবি রোগী আছে, তাদের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী রোগী শতকরা দুই থেকে পাঁচ ভাগ। আমাদের এখানে বর্তমানে ৬০ জনের মধ্যে ভর্তি আছে। শিশু এমডিআর অনেক কম। আমরা চার-পাঁচজন রোগী পেয়েছি। সব বয়সী রোগীদের মধ্যেই যক্ষ্মা পাচ্ছি। তবে তরুণদের মধ্যে হার বেশি। তাদের সচেতনতার ঘটতি রয়েছে। একই সঙ্গে তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার অনেক বেশি। ষাটোর্ধ্ব ও শিশুদের এটি কম।’
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিভাগীয় পরামর্শক ডা. আহমেদ পারভেজ জেবিন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওষুধ চলাকালে কোনো কারণে রোগী যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে তা যক্ষ্মায় মৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু এসব মৃত্যুর একটি বড় কারণ কোমরবিডিটি। অর্থাৎ যক্ষ্মার সঙ্গে অন্য আরেকটি রোগ থাকার জন্য, যেমন- সেই রোগীর যদি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা সিকেডি (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ) থাকে এবং ওই সব কারণে তার মৃত্যু হয়, তাহলে তা যক্ষ্মায় মৃত্যু বলে গণ্য হয়। এমনকি কোনো যক্ষ্মা রোগী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও তা যক্ষ্মায় মৃত্যু হিসেবে চিহ্নত হয়। এই মৃত্যুর সংখ্যা আন্তর্জাতিকভাবে পরিবর্তন হয়া প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার জিরো রোগী ও জিরো আউট অব পকেট কস্ট নিশ্চিতে কাজ করছে। ২০৩০ সালে এটি বাস্তবায়নে একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি সফল করতে হলে আমাদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে হবে।’
স্বাআলো/এসআর