ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রায় প্রতিদিনই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মানুষ ঠেলে পাঠাচ্ছে, যা ‘পুশ ইন’ নামে পরিচিত। চলতি মে মাসের মাত্র ২২ দিনে (৭ থেকে ২৯ মে) এ পদ্ধতিতে এক হাজার ১০৬ জনকে বাংলাদেশে পুশ ইন করেছে বিএসএফ। এই কাজে সীমান্তবর্তী ১৭টি জেলার অন্তত ২৬টি স্থানকে বেছে নিয়েছে তারা। বিজিবি সদর দফতর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ২২ দিনে ২৬টি দুর্গম সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এক হাজার ১০৬ জনকে পুশ ইন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুশ ইনের ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর ও পাল্লাথল সীমান্ত দিয়ে, যেখানে মোট ৩৪০ জনকে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। যা মোট পুশ ইনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়াও খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং ইউনিয়নের আচালং সীমান্ত দিয়ে ১১৮ জন, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নয়াগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ১১৫ জন, কুড়িগ্রামের রৌমারী, ভূরুঙ্গামারীর ভাওয়ালকুড়ি ও ফুলবাড়ী উপজেলার বালাতাড়ী সীমান্ত দিয়ে ৯৩ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে।
অন্যান্য যেসব সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার কেলেঙ্গা (১৯), সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছনবাড়ী (১৬), কুমিল্লা সদর উপজেলার গোলাবাড়ীর কমুয়া (১৩), ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী (৩৯), লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার রহমতপুর গাটিয়ার ভিটা ও শ্রীরামপুর (৭৮), ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বৈরুচুনা (১৯), পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের বড়বাড়ী (৩২), দিনাজপুরের বিরল উপজেলার এনায়েতপুর ও রামচন্দ্রপুর (১৫), চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বিভীষণ (১৭), চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের হরিহরনগর ও দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা নিমতলী (১৯), মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর-মাজপাড়া (৩০), ঝিনাইদহের মহেশপুরের অধীন কুসুমপুর ও বেনীপুর (৪২) এবং সাতক্ষীরার কুশখালী সীমান্ত দিয়ে ২৩ জন। এছাড়া সুন্দরবনের গহিন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকা দিয়েও ৭৮ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে।
মুজিবনগর সীমান্ত দিয়ে শিশুসহ ৩০ জনকে পুশইন
বিজিবি এই ২৬টি সীমান্ত এলাকাকে পুশ ইনের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব এলাকায় বিজিবি টহল জোরদার করাসহ বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলেও তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে কর্মকর্তারা জানান। বিজিবি কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু এলাকায় ঘনজঙ্গল ও দুর্গম পাহাড় থাকায় বিজিবির টহল কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। বিএসএফ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সুযোগ বুঝে একেক দিন একেক সীমান্ত দিয়ে রাতের অন্ধকারে মানুষ পুশ ইন করে চলে যায়।
মৌলভীবাজার সীমান্তে এত বেশি পুশ ইনের কারণ সম্পর্কে সিলেট বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হাসান বলেন, মৌলভীবাজার সীমান্ত এলাকায় পাহাড় ও ঘনজঙ্গল থাকায় বিজিবির টহল দিতে অসুবিধা হয়। বিওপি থেকে কোনো কোনো এলাকায় যেতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। এই জনমানবহীন এলাকায় বিএসএফ রাতের অন্ধকারে ভুক্তভোগীদের জিরো পয়েন্টের দিকে ঠেলে দেয়।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য যেমন দিল্লি, আসাম, হরিয়ানা থেকে তাদের আটক করে স্থানীয় পুলিশ। এরপর থানায় জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর কয়েকদিন আটকে রাখা হয়। সংখ্যা শতাধিক হলে ট্রেন ও গাড়িতে করে পুলিশি পাহারায় তাদের সীমান্ত এলাকায় এনে বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে বিএসএফ গভীর রাতে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশ ইন করে। হরিয়ানা থেকে পুশ ইন হওয়া আমির হোসেন জানান, স্ত্রী ও চার সন্তানসহ তাদের পুরো পরিবারকে কঠোর পাহারায় সীমান্তে এনে রাতে ছেড়ে দেয়া হয় এবং বলা হয় ‘সামনে হাঁটো, না হলে গুলি করব’। পরে বিজিবি তাদের উদ্ধার করে।
সীমান্তে ভারতের পুশইনের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
উল্লেখ্য, ২৭ মে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ৩৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ভারত ফেরত পাঠায়, যারা মানব পাচারের শিকার হয়ে ভারতের বিভিন্ন সেফহোমে ছিলেন। তবে এটি বিএসএফের ‘পুশ ইন’ কার্যক্রম থেকে ভিন্ন, এটি একটি আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর প্রক্রিয়া।
এদিকে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতেও পুশ ইন অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের রেমা সীমান্ত দিয়ে ২২ জন, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মথুয়া সীমান্ত দিয়ে ১৩ জন, মৌলভীবাজারের জুড়ী সীমান্ত দিয়ে ১০ জন, কমলগঞ্জ উপজেলার দুটি সীমান্ত দিয়ে ১৯ জন এবং খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে আরও ১৪ জনকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ। এই ঘটনাগুলো বিএসএফের ধারাবাহিক পুশ ইন কার্যক্রমকেই নির্দেশ করে।
স্বাআলো/এস