সৈকত চৌধুরী: বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা চিরকালই ছিলো দৃঢ়। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা ছাড়া গণতন্ত্র কখনোই পরিপূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা ঘটে, যা এই প্রত্যাশার মূলে আঘাত করে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জামায়াতে ইসলামীর আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমানকে জামায়াতের মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ঘটনা আমাদের সেই আশঙ্কাকেই আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমন একটি পদ, যেখানে দেশের জনগণ ন্যায়বিচারের এক নিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি দেখতে চান। এই পদে থাকা ব্যক্তির থেকে প্রত্যাশিত হয় তিনি রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন, সকল পক্ষের প্রতি সমান আচরণ করবেন এবং আইনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন। কিন্তু যখন একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সরাসরি একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে মনোনয়ন পান এবং সে দলের অনুষ্ঠানে অংশ নেন, তখন নিরপেক্ষতার প্রশ্ন অত্যন্ত প্রকট হয়ে ওঠে। এতে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগে—যারা আইন রক্ষা করবেন, তারা যদি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার কোথায়?
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক দল। এ দলের বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে এবং অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারও হয়েছে। স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী একটি দলের পক্ষে দেশের উচ্চ আদালতের একজন কর্মকর্তা যদি দাঁড়ান, তবে তা শুধু একটি ব্যক্তিগত অবস্থান নয়, বরং দেশের বিচার ব্যবস্থার উপরও অগাধ প্রভাব ফেলে। জনগণ তখন বিশ্বাস হারাতে শুরু করে, ভাবতে শুরু করে বিচার কি তবে পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে?
সাইফুর রহমানের ঘটনাটি আরো গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয় এই কারণে যে, এটি বিচার বিভাগের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার সংকটকে সামনে নিয়ে এসেছে। যখন বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়ে প্রকাশ্যে আসে, তখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে তার বিচারিক সিদ্ধান্ত কি আদৌ নিরপেক্ষ হবে? তিনি কি আদৌ ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন?
এই প্রশ্নগুলো শুধু একটি ব্যক্তির বা একটি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এর প্রভাব গোটা বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং সর্বোপরি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর পড়ে। ন্যায়বিচারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যদি জনগণ মনে করে বিচারকরা বা আইন কর্মকর্তারা দলীয় রাজনীতির ছায়াতলে রয়েছেন, তাহলে তা সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো জনগণের আস্থা। বিচার বিভাগ যখন নিরপেক্ষ ও স্বাধীন থাকে, তখন জনগণ আইনের আশ্রয়ে শান্তি খুঁজে পায়। কিন্তু যদি সেই বিচার ব্যবস্থার ওপরই সন্দেহের ছায়া পড়ে, তাহলে রাষ্ট্রের ভিত নড়ে যায়। তখন আইনের শাসন শুধু কাগজে লেখা কিছু শব্দমাত্র হয়ে দাঁড়ায়। সাইফুর রহমানের ঘটনাটি তাই একটি বড় সতর্কবার্তা। এটি দেখিয়ে দিল, কত সহজে রাষ্ট্রের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্তরে রাজনৈতিক প্রভাব প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বারবার সংগ্রাম করতে হয়েছে। দেশের সংবিধান পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে, রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ—আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ—একটি অপরটির থেকে স্বাধীন থাকবে। বিচার বিভাগের ওপর জনগণের নির্ভরতা যত বেশি, রাষ্ট্র তত বেশি শক্তিশালী হয়। অথচ আজ আমরা দেখছি, এই স্তম্ভেই চিড় ধরছে। এই চিড় আজ সামান্য মনে হলেও, যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে তা ভবিষ্যতে বড় ধসের রূপ নিতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হলো-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোনো সভায় অংশ নিলে বা নির্বাচনী প্রার্থী হিসেবে পরিচয় পেলে, তাঁর বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নতুবা অন্যরা এই উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে, যা বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির ময়দানে পরিণত করবে।
রাষ্ট্রের উচিত হবে এমন কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা, যাতে বিচার বিভাগের সদস্যরা কোনোভাবেই সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে না পারেন। যদি কেউ রাজনীতিতে যোগ দিতে চান, তবে অবশ্যই আগে সরকারি পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এর মাধ্যমে কেবল বিচার বিভাগের পবিত্রতা রক্ষা করা যাবে না, বরং জনগণের আস্থাও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।
এছাড়া বিচার বিভাগের প্রতি জনসাধারণের আস্থা পুনর্গঠনে স্বচ্ছ তদন্ত, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং নৈতিকতার মানদণ্ড কঠোরভাবে অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শুধু আইনগত দিক থেকে নয়, নৈতিক দিক থেকেও অনুকরণীয় হতে হবে।
একটি রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে এবং সম্মান পায়, যখন তার বিচার ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও পক্ষপাতমুক্ত থাকে। পক্ষপাতের ছায়ায় যদি বিচার বসে, তবে গণতন্ত্র কাঁদে, রাষ্ট্র দুর্বল হয় এবং আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আজকের ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়-আস্থা ও ন্যায়বিচার রক্ষার জন্য শুধু শব্দের নয়, কাজেরও প্রয়োজন। এখনই সময় বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের। না হলে, জনগণ যখন ন্যায়বিচার চাইবে, তখন তাদের আর আশ্রয় খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
আমরা চাই, বিচার বিভাগ হবে সাহসী, স্বাধীন এবং সত্যিকারের নিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক। এটি কোনো ব্যক্তির, দলের বা সরকারের নয় এটি গোটা জাতির দাবি।
স্বাআলো/এস