মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার নতুন বিস্ফোরণ ঘটেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবার চরমে পৌঁছেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এতে অংশগ্রহণ করে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে দেয়া এক ভাষণে এই হামলার ঘোষণা দেন।
তার ভাষ্যমতে, এই হামলা ছিলো অসাধারণ সফল। আমরা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছি। ইরান যদি শান্তির পথে না আসে, তাহলে আরও অনেক লক্ষ্য আমাদের হাতে রয়েছে।
এই হামলায় ইরানের ফোর্ডো, নতাঞ্জ ও ইসফাহান এলাকায় অবস্থিত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং ইরানকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে চাপে ফেলার একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ।
ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা: যুক্তরাষ্ট্রকে খামেনির হুঁশিয়ারি
হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান ইসরায়েলের দিকে একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, তারা হামলার আগেই ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে। নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে জানান, এর চিরস্থায়ী ফলাফল হবে এবং ইরান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনাটি একটি পার্বত্য অঞ্চলের গভীরে নির্মিত, যেখানে কক্ষগুলো মাটির প্রায় ৯০ মিটার নিচে অবস্থিত। হামলার আগে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ইরান সেখানে ডাম্প ট্রাক এবং মাটি স্তূপ করে প্রবেশপথ সুরক্ষিত করছিল।
ইরানি সংসদ সদস্য মোহাম্মদ মানান রাইসি বলেন, ক্ষয়ক্ষতির বেশিরভাগ অংশই ভূ-উপরিভাগে, যা সহজেই পুনর্গঠনযোগ্য। এই বক্তব্য ট্রাম্পের সম্পূর্ণ ধ্বংস দাবির সাথে সাংঘর্ষিক।
হামলার পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাস বদলে দিয়েছে। তারা যা করেছে, তা বিশ্বের কোনো দেশ পারেনি। প্রো-ইসরায়েল লবি এআইপ্যাকের মতে, এখন যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্রদের সঙ্গে মিলে আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায় একযোগে কাজ করতে হবে।
ইরানে ‘পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর’ গুঞ্জন
অন্যদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই হামলাকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করে সামরিক নয়, কূটনৈতিক সমাধানের আহবান জানান। নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোও শান্তিপূর্ণ আলোচনার আহবান জানিয়েছে এবং অতিরিক্ত সামরিক উত্তেজনা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। মার্কিন মুসলিম অধিকার সংগঠন CAIR এই হামলাকে ইসরায়েলের চাপেই সংঘটিত এবং আন্তর্জাতিক আইনবহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছে। হামাস ও হুথি বিদ্রোহীরা এই হামলাকে সরাসরি আগ্রাসন আখ্যা দিয়ে পাল্টা জবাবের হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
তেহরানভিত্তিক বিশ্লেষক আব্বাস আসলানি এই পরিস্থিতিতে তিনটি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছেন সীমিত সামরিক পাল্টা জবাব, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ যেখানে ইরান ও তার মিত্ররা একযোগে অংশ নেবে, অথবা হাইব্রিড কৌশল হিসেবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও এই হামলা ঘিরে মতবিভাজন তৈরি হয়েছে। রিপাবলিকান সিনেটর মিচ ম্যাককনেল এই হামলাকে তেহরানের আগ্রাসী মনোভাবের জবাব বলে প্রশংসা করেছেন। অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাট সেনেটর মার্ক ওয়ার্নার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনীয় ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে এখনো বারুদের গন্ধ। ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব ক্রমেই বিস্তৃত ও জটিল হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ বৈশ্বিক কূটনীতির জন্য এক নতুন সংকটের সূচনা করেছে। বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। শান্তি না যুদ্ধ এই দ্বিধাবিভক্ত সময়েই নির্ধারিত হবে ভবিষ্যতের পথচলা।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান
স্বাআলো/এস