বিএনপি-জামায়াতের ডাকা তিনদিনের অবরোধের তৃতীয় দিনে বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে এক ডজনেরও বেশি যানবাহনে। এনিয়ে তিনদিনে ৩৪টি যানবাহনে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীর উত্তরা আজমপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পরিস্থান পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, পরিস্থান বাসে যাত্রীবেশে উঠে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় গাড়িতে ১২ থেকে ১৪ জন যাত্রী ছিলো। আগুন লাগিয়ে পেছনের জানালা দিয়ে পালিয়ে যায় কয়েক যুবক।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ডিউটি অফিসার জানান, সকাল ৭টায় ওই গাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এর আগে ভোর পৌনে ৫টার দিকে মোহাম্মদপুরে মৌমিতা পরিবহনের দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের কর্মকর্তা শাজাহান শিকদার জানান, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ ভাঙা মসজিদ এলাকায় মৌমিতা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস দাঁড়ানো ছিলো। এ সময় দুর্বৃত্তরা বাসটিতে আগুন দেয়। পরে সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দ্রুত আগুন নেভান।
বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের এশিয়ান হাইওয়েতে তুলাবোঝাই একটি কাভার্ডভ্যান ও একটি ট্রাক ভাঙচুর করে আগুন দিয়েছে অবরোধকারীরা। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় চার জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সকালে রূপগঞ্জ উপজেলার কুশাব এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, অবরোধের তৃতীয় দিন যান চলাচল স্বাভাবিক ছিলো। তবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। রূপগঞ্জে অবরোধকারীরা কাভার্ডভ্যানে আগুন দেয়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চারজনকে গ্রেফতার করে।
এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে একটি গাড়ি ভাঙচুর করার চেষ্টা করে। সে সময় পুলিশ গিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে বলে জানান এসপি।
অবরোধের তৃতীয় দিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) সকালে মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক ও সানারপাড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক টি এইচ তোফাসহ আরো দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ জানায়, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহমুদের নেতৃত্বে মহাসড়কের মাদানীনগর এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে করে মিছিল করে কয়েকজন। এ সময় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তিন জনকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ সাজেদা হাসপাতালের সামনে জেলা কৃষক দলের নেতাকর্মীরা দুটি বাস ভাঙচুর করে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করেন।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা বলেন, সকালে বিএনপির নেতাকর্মীরা অগ্নিসংযোগ করে মিছিল বের করেছে। এ সময় তিন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর লালপোলে চিনিবোঝাই একটি ট্রাকে আগুন দিয়েছে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। বুধবার (১ নভেম্বর) দিবাগত রাত ৪টার দিকে এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
ফেনী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর ওয়াসি আজাদ বলেন, বুধবার দিবাগত রাত ৪টা ২০ মিনিটে খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিভিয়েছি। আগুনে ট্রাকের সামনের অংশ পুড়ে গেছে।
অবরোধের তৃতীয় দিনে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় দুটি বাসে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় আরেকটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) ভোরে উপজেলার কাপ্তাই সড়কের চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা এবি ট্রাভেলসের একটি বাসে আগুন দেয়। বাসটি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
রাজবাড়ীর কালুখালীতে মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে অবরোধকারীরা। কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। বুধবার (১ নভেম্বর) রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের কালুখালী উপজেলার চাঁদপুর ব্রিজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
রাজবাড়ীর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (পাংশা সার্কেল) সুমন কুমার সাহা বলেন, চালকের কাছ থেকে মোটরসাইকেল কেড়ে এনে আগুন দিয়েছে অবরোধ সমর্থনকারীরা। এ সময় তারা চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চারদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় মোটরসাইকেলের মালিক বাদী হয়ে রাতেই ১০ জনের বিরুদ্ধে কালুখালী থানায় মামলা করেছেন। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
বগুড়ায় অবরোধের শেষ দিন বৃহস্পতিবার সকালে শহরতলির তিনমাথা বেলাইল এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে কমপক্ষে আটটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় কয়েকটি ট্রাক ও অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয়েছে। এছাড়া বারপুর এলাকায় সার্ভিসিং করতে যাওয়ার সময় পিকেটাররা পেট্রোল ঢেলে একটি ট্রাকে আগুন দিয়েছে।
বিএনপি ও জামায়াতের তিনদিনের অবরোধে সারাদেশে ৩৪টি অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। ৩১ অক্টোবর (মঙ্গলবার) সকাল ৬টা থেকে ২ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এসব নাশকতার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এরমধ্যে ঢাকা সিটিতেই ১২টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, ঢাকা বিভাগে (গাজীপুর, কালিয়াকৈর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ) ৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে (সীতাকুণ্ড, কর্ণফুলি, রাঙ্গুনিয়া, ফেনী, চাঁদপুর, বায়েজিদ) ৮টি, রাজশাহী বিভাগে (বগুড়া, রায়গঞ্জ) ৪টি, রংপুর বিভাগে (পার্বতীপুর) ১টি, বরিশাল বিভাগে (চরফ্যাশন) ১টি, ময়মনসিংহ বিভাগ (কেন্দুয়া) ১টি ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৮টি বাস, ৪টি কাভার্ড ভ্যান, ৫টি ট্রাক, ১টি প্রাইভেটকার, ৩টি মোটরসাইকেল, ২টি বাণিজ্যিক পণ্যের শো রুম, ১টি পুলিশ বক্স পুড়ে যায়।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা দেখা গেছে, দিনের বেলা থেকে রাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এই তিনদিনে মোট ৩৪টি ঘটনার মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৫টা পর্যন্ত ১৯টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাকি ১৫টি দিনের অন্যান্য সময় সংঘটিত হয়েছে।
স্বাআলো/এসএ