খুলনায় ১৬ থেকে ২০ গ্রেড পদে জনবল নিয়োগে চলছে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) বাইরে থাকায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। এতে স্কুল-কলেজ-মাদারাসার প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের মাধ্যমে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য চলছে।
খুলনা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীসহ খুলনার ৯ উপজেলায় (ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রূপসা, দিঘলিয়া, ফুলতলা ও তেরখাদা) এডুকেশন ইনস্টিটিউট আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (ইআইআইএন) রয়েছে এমন মাধ্যমিক বিদ্যালয়-মাদরাসা ও কলেজের সংখ্যা ৬১৭টি। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংখ্যা ৪২০টি, মাদরাসার সংখ্যা ১২৫ ও কলেজ সংখ্যা ৭২টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৬-২০ গ্রেড পদে (অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ল্যাব সহকারী, অফিস সহায়ক, নিরাপত্তাকর্মী, নৈশপ্রহরী, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী) জনবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ উঠছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। নিয়োগসংশ্লিষ্টরা প্রতিটি পদে ৯ লাখ থেকে ১৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিচ্ছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের পল্লীশ্রী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে নিয়োগে মোটা অঙ্কের অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরে গত ১ অক্টোবর খুলনা জেলা প্রশাসকের কাছে এলাকাবাসী অভিযোগও দেন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, অফিস সহায়ক পদে ১৩ লাখ ও নিরাপত্তাকর্মী পদে ১২ লাখ টাকা লেনদেন হচ্ছে। তারপরো কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই নিয়োগ কমিটি তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
স্থানীয় বাসিন্দা রথীন কুমার মন্ডল জানান, স্মৃতি মন্ডল অফিস সহায়ক পদে লিখিত ও ভাইভাতে প্রথম হয়েছেন। অথচ তাকে বাদ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পছন্দের অন্য প্রার্থী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
চলতি বছর ১০ অক্টোবর একই উপজেলার শোভনা বিরাজময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক ও আয়া পদের জন্য নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু নিয়োগে বিস্তর ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। আয়া পদে চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে শোভনা গ্রামের বিশ্বজিৎ মল্লিকের স্ত্রী তমা রানী মল্লিকের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা ও একই গ্রামের সাগরের কাছ থেকে নগদ ১০ লাখ টাকা নেয়া হয়। জেলা প্রশাসকের দফতরে লিখিত এমন অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহিম। পরে স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে পরীক্ষা স্থগিত করে নিয়োগ কমিটি। তবে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে এর আগেও দুইবার নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত হয়।
একই উপজেলার ধামালিয়ার ফারাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গত ৪ মার্চ ৪টি পদে নিয়োগে অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় এলাকায় মানববন্ধনও হয়। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শুনানি শেষে নিয়োগ বাতিল করেন।
দাকোপ উপজেলার বাসিন্দা শামসুর নাহার জানান, উপজেলার নলিয়ান দাখিল মাদরাসার শূন্য তিনটি পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। চলতি বছর ২২ আগস্ট নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন লুৎফর রহমান সানা। তিনিও ২৭ আগস্ট একই প্রেসক্লাবে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করেন। এছাড়া তার সন্তান আরাফাত রহমান বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলাও করেন। মামলা চলমান রয়েছে। কিন্তু এরপরও নিয়োগ কমিটি নিয়োগ সম্পন্ন করেছে।
তিনি আরো জানান, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে একই পরিবারের দুইজনকে আয়া পদে সুমাইয়া বেগম ও নিরাপত্তাকর্মী পদে তরিকুল ইসলামকে চাকরি দেয়া হয়েছে।
কয়রা উপজেলার লালুয়া বাগালি মোশারফ মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে অফিস সহায়ক, নিরাপত্তাকর্মী, ঝাড়ুদার ও আয়া পদে জনবল নিয়োগ দিতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নিতে চলতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়সহ বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেন বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য আকরাম হোসেন সানা।
গত বছর ডিসেম্বর মাসে পাইকগাছায় ইউআরএসএইচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগে বলা হয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কাম নৈশপ্রহরী পদে মোক্তার হোসেনের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা গ্রহণ করা হয়। তবে প্রশান্ত সরকার নামে এক ব্যক্তি ১০ লাখ টাকা ঘুষ টাকা দেয়ায় পরে মোক্তারকে বাদ দিয়ে প্রশান্তকে চাকরি দেয়া হয়েছে। যা নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়।
খুলনা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, বেকারত্ব লাঘবে সম্প্রতি ১৬-২০ গ্রেড পদে জনবল নিয়োগ দেয়ার নির্দেশনা এসেছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ঘুষ নেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ সত্য। তবে অভিযোগ এলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
স্বাআলো/এসএ