জাপানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির পথে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মে মাসের জাপান সফরে এ বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যেই ‘ডিফেন্স প্রকিওরমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি ট্রান্সফার’ শীর্ষক চুক্তিটি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
চুক্তিটি সই হলে বাংলাদেশ সহজে জাপান থেকে উন্নতমানের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে পারবে। তবে চুক্তি বাস্তবায়নে জাতিসংঘ সনদের (UN Charter) শর্ত মানতে হবে উভয় দেশকে। এটি শুধু প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ নয়, বরং এর মাধ্যমে সামরিক ব্যবহারেও আন্তর্জাতিক নীতিমালার একধরনের নৈতিক ও রাজনৈতিক সীমারেখা আরোপ করা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সফরের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, “উভয় পক্ষ জাপানের অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্সের অধীনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে পাঁচটি টহল নৌকা সরবরাহসহ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।”
চুক্তির কাঠামো ও ইউএন চার্টারের প্রভাব
চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারায় উল্লেখ আছে, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির ব্যবহার জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য ও নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, “এই শর্ত জাপানের নিজস্ব আইনি ও রাজনৈতিক কাঠামোর জন্য অত্যাবশ্যক। এতে নিশ্চয়তা মিলবে যে, সরঞ্জামগুলো আঞ্চলিক সংঘাতে বা আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হবে না।”
জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ১ ও ২(৪)-এর আলোকে রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে এই চুক্তির অধীনে প্রাপ্ত প্রযুক্তি বা অস্ত্র সরাসরি আক্রমণাত্মক কোনো কার্যক্রমে ব্যবহার করা যাবে না।
জাপানের ভূ-কৌশলগত বদল ও বাংলাদেশের গুরুত্ব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকে জাপানের প্রতিরক্ষা নীতি ছিল অত্যন্ত সংযত। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি (NSS) অনুযায়ী, জাপান তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করে এবং কৌশলগত দিক থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করে।
এই নীতির অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে জাপান প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়। পরবর্তী সময়ে মিতসুবিশি কর্পোরেশনের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে তাদের উৎপাদিত সরঞ্জাম বিক্রির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করে।
চুক্তি অনুমোদনের প্রক্রিয়া
বর্তমানে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এখন দুই দেশের সরকারিভাবে অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের কেবিনেট বা অ্যাডভাইজারি কাউন্সিলের অনুমোদনের পর চুক্তিটি সইয়ের জন্য উপস্থাপন করা হবে। অপরদিকে জাপানে বিষয়টি কেবিনেট এবং সংসদের প্রতিরক্ষা কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হবে।
চুক্তিটি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা খাতে নয়, বরং কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।