আন্তর্জাতিক

কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি হামলা ‘যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | June 24, 2025

ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি আল-উদেইদ-এ সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই হামলা নিয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদক ডোরসা জাব্বারি বলেন, “মানুষ এখানে আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। এটি অত্যন্ত নাটকীয় অভিজ্ঞতা।”

তিনি জানান, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ তাকে বার্তা পাঠাচ্ছেন, জানতে চাচ্ছেন কী ঘটেছে এবং কাতারের মতো শান্তিপূর্ণ দেশ কীভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো।

ডোরসা জাব্বারি আরও বলেন, “এই হামলার লক্ষ্য ছিল না সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। বরং এটি ছিল একটি শক্তিশালী বার্তা — যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সামরিক উপস্থিতিকে জানিয়ে দেওয়া যে, ইরান সরাসরি হামলা চালানোর সক্ষমতা রাখে।”

তিনি মনে করেন, এখন এই উত্তেজনা কোন দিকে মোড় নেবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর।

এদিকে, কাতারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ইরানি হামলার পর তিনি সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফিরে আসার তাগিদ দিয়েছেন।

ম্যাক্রোঁ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “আমি সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে, উত্তেজনা হ্রাস করতে এবং পুনরায় আলোচনা টেবিলে ফিরে আসতে আহ্বান জানাচ্ছি। এই বিশৃঙ্খলার চক্রের ইতি টানতেই হবে।”

 কাতারের রাজধানী দোহা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আল উদেইদ এয়ার বেস-এ হামলার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। কাতার-ভিত্তিক জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মেহরান কামরাভা এ ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, “আমরা বিশাল বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম, পুরো ভবন কেঁপে উঠল, জানালাগুলো কাঁপছিল, আর বাইরে তাকিয়ে দেখি রাতের আকাশে অসংখ্য আলোকচ্ছটা উড়ছে।”

অধ্যাপক কামরাভা, যিনি গত ১৮ বছর ধরে কাতারে বসবাস করছেন, তিনি আরও বলেন, “আমি যে কম্পাউন্ডে থাকি, সেখানকার অনেক প্রতিবেশী দৌড়াতে শুরু করে। অনেকেই ভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এমন দৃশ্য এর আগে কখনও দেখিনি।”

তিনি জানান, এই প্রথমবারের মতো তিনি কাতারে সাইরেনের শব্দ শুনেছেন। “এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে যথেষ্ট আতঙ্ক দেখা গেছে,” বলেন কামরাভা।

উল্লেখ্য, আল-উদেইদ ঘাঁটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে এবং এটি ফরওয়ার্ড হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলা একটি প্রতীকী ও কৌশলগত বার্তা, যার মাধ্যমে ইরান একদিকে তার প্রতিশোধের ঘোষণার বাস্তবায়ন করল এবং অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বকে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করল— এই উত্তপ্ত অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে, নাকি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজা হবে।

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি আল উদেইদ এয়ার বেস এখন বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে। ইরানের হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া এ ঘাঁটির গুরুত্ব, প্রস্তুতি এবং এর ওপর আঘাতের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।

কাতারের রাজধানী দোহার দক্ষিণ-পশ্চিমে মরুভূমিতে অবস্থিত ২৪ হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত এই ঘাঁটি স্থাপিত হয় ১৯৯৬ সালে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের ফরওয়ার্ড হেডকোয়ার্টার, যা মিশর থেকে কাজাখস্তান পর্যন্ত বিশাল এলাকায় মার্কিন সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

ঘাঁটিতে কাতার এমিরি এয়ার ফোর্স, যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ফোর্স, যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ার ফোর্সসহ অন্যান্য দেশের সেনা মোতায়েন রয়েছে।

দীর্ঘ রানওয়ে ও দ্রুত মোতায়েনের সুবিধার কারণে আল উদেইদ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতির অন্যতম মূল কেন্দ্র। কাতার ইতোমধ্যে ঘাঁটির উন্নয়নে ৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা মার্কিন করদাতাদের বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের জেরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালে ইরান পাল্টা হামলার অংশ হিসেবে আল উদেইদ ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।

কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী এসব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে কাতার সাময়িকভাবে আকাশপথ বন্ধ ঘোষণা করে।

যুক্তরাষ্ট্র আগেই ‘ফোর্স প্রোটেকশন’ বা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। জুনের শুরুর দিকে উপগ্রহ চিত্রে যেখানে ৪০টির মতো সামরিক বিমান দেখা গিয়েছিল, ১৯ জুনের চিত্রে তা কমে তিনটিতে নেমে আসে। আশঙ্কাজনক বিমানগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।

কাতার এ হামলাকে “রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের জঘন্য লঙ্ঘন” বলে নিন্দা জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেন,
“আমরা আল উদেইদ এয়ার বেসে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।”

Shadhin Alo