মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে আবারও যুদ্ধের কালো মেঘ। যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ যখন ছড়িয়ে পড়েছে, তখন শুধু ইরান নয়, গোটা বিশ্বের সামনে জেগে উঠছে এক শঙ্কার ছায়া—এই কি তাহলে আরেকটি বড় যুদ্ধের শুরু?
যে অঞ্চলটিতে ২১ শতকে ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়া সংকট, এবং ইয়েমেন সংঘাতের রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয়েছে, সেখানে নতুন করে ইরানকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হলে তার পরিণতি শুধু ওই অঞ্চলের জন্যই নয়, বিশ্বশান্তি ও জ্বালানি বাজারের জন্যও হবে ভয়াবহ।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি: কৌশল না আগ্রাসন?
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল থেকে উড্ডয়ন করা বি-২ বোমারু বিমানগুলোর লক্ষ্য সম্ভবত গুয়াম কিংবা দিয়েগো গার্সিয়ার ঘাঁটি—যেখান থেকে সরাসরি ইরানে আঘাত হানা সম্ভব। এই বিমানগুলো পারমাণবিক বাঙ্কার লক্ষ্য করে হামলা চালানোর উপযোগী, যা ইরানের ‘ফর্দো’ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার ইঙ্গিত দিতে পারে।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি দুই সপ্তাহ সময় নিচ্ছেন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য। তবে এই সময়ের মধ্যেই তিনি হামলার পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছেন—এটাই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
খামেনির বাংকারে আশ্রয়: নেতৃত্ব সংকটের ইঙ্গিত?
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির বাংকারে আশ্রয় গ্রহণ এবং যোগাযোগের সকল প্রযুক্তি বন্ধ করে দেওয়া কেবল প্রতিরক্ষা পদক্ষেপ নয়, এটি এক ধরনের গভীর উদ্বেগেরও প্রতিচ্ছবি। তাঁর উত্তরসূরি ঠিক করে রাখাও দেখায় যে ইরান এবার সত্যিকারের যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যুদ্ধ ছড়াবে পুরো অঞ্চলজুড়ে
ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়লে লোহিত সাগর ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চল অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে। ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী ইতিমধ্যে হুমকি দিয়েছে যে তারা মার্কিন যুদ্ধজাহাজে হামলা চালাবে। ইরাকে থাকা ইরানপন্থী গোষ্ঠী, লেবাননের হিজবুল্লাহ কিংবা সিরিয়ার সশস্ত্র সংগঠনগুলোও এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে।
তেল উত্তোলনের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল আহভাজে ইসরায়েলি হামলার পর বিশাল ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে—এই হামলা যদি প্রতিশোধ পর্বে গড়ায়, তাহলে পারস্য উপসাগর হয়ে উঠতে পারে এক যুদ্ধমঞ্চ।
বিশ্ব কূটনীতির চরম পরীক্ষা
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ওপরই নির্ভর করছে, এই আগুন জ্বলবে না নিভে যাবে। রাশিয়া ও ফ্রান্স এখন পর্যন্ত কূটনৈতিক ব্যাকচ্যানেল সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছে। পুতিন ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং মাখোঁ দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কতটা কার্যকর? যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী অবস্থান এবং ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক ভূমিকায় কূটনীতি কি আদৌ জোরালোভাবে কাজ করতে পারবে?
বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য কী বার্তা?
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে—এটি নিশ্চিত। পারস্য উপসাগরের উত্তপ্ত পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় এবং মুদ্রাস্ফীতিও বেড়ে যাবে।
এই মুহূর্তে বিশ্ব যদি সংঘাতের দিকে না গিয়ে কূটনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নেয়, তবে মধ্যপ্রাচ্য এক বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তবে ২০২৫ সাল ইতিহাসে আরও একটি রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে।