সাংগঠনিক দুর্বলতায় ক্ষুদ্ধ রংপুর আ.লীগের নেতাকর্মীরা

হারুন উর রশিদ সোহেল, রংপুর: কোটা সংস্কার ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে বিএনপি-জামায়াত-শিবির যখন সারাদেশের ন্যায় রংপুরকে দখলে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে ছিলো তখন রংপুরের অধিকাংশ নেতাকর্মী ছিলো নিষ্কিয়।

হামলাসহ নানা রকম ভয়ে মাঠে নামেনি বড় পদবিধারী নেতাদের বেশির ভাগই। এমন পরিস্থিতিতে ১৮ জুলাই রংপুরে স্মরণকালের ভয়াবহ নাশকতা ও তাণ্ডব চালায় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ দুর্বৃত্তরা।

এতে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের অফিসে আগুন ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটায়। এই ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের নিস্কীয়তায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে।

তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া আর পদ-পদবির জন্য মাঠে নামা নেতারা ‘যে গর্তে লুকিয়ে আছেন’ সেখানেই থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

তবে অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, আহবায়ক ও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগসহ তৃণমূলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। রংপুর মহানগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডসহ জেলার অধিকাংশ উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কমিটি মেয়াদ উত্তীর্ণ। মহানগরীর ছয়টি থানার কমিটি নিয়ে বির্তক থাকায় এখনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিকলীগ, কৃষকলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের অবস্থা বেহাল।

সবখানেই গ্রুপ-উপগ্রুপিং, বিরোধ চলমান রয়েছে। যা নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে চরম ক্ষোভও রয়েছে।

তারা বলছেন, অসন্তোষ, নেতৃত্ব সংকট ও সমন্বয়হীনতার কারণে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে রংপুর মহানগরীসহ জেলা আওয়ামী লীগ। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারায় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এর আগে গত ১৮ জুলাই বিকেলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর ভর করে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ তাদের সংগঠনগুলো রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ মহানগরীজুড়ে নাশকতা চালায়। নাশকতাকারীদের হাত থেকে বাদ যায়নি যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ ও সরকারি স্থাপনা।

তবে এ সময় প্রতিরোধ করতে দেখা যায়নি আওয়ামী লীগ বা অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের। এরপর থেকেই নানা মহলে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটির সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ত্যাগী নেতারা বলছেন, আন্দোলনের সময় নিজেদের নিরাপদ রাখতে তৎপর ছিলেন গত কয়েক বছরে বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারীরা, যারা পদ বাগিয়ে নিয়ে বনে গেছেন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা। অনেক আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারও বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে অভিযোগ করেন তারা।

অভিযোগ রয়েছে, ১৫ বছরের বেশি দল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়েছেন রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠনের অনেক হাইব্রিড নেতারা। বড় বড় পদে বাগিয়ে তাদের সুবিধা পাইয়ে দিতে সহায়ক ছিলেন দলের কতিপয় শীর্ষ নেতা। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে ঠিকাদারি দল থেকে সব ধরনের সুবিধা নিয়েছেন হাইব্রিড নেতারা। ত্যাগী ও পোড় খাওয়া নেতাদের বেশিরভাগই ছিলেন অবহেলিত। অনেকেই হয়রানির শিকারও হয়েছেন।

রংপুর মহানগরীর ৩২ নং ওয়ার্ড কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ বলেন, তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইতোপূর্বে ওয়ার্ড ও তাজহাট থানা সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী ছিলেন। প্রার্থী হতে গিয়ে নানা ধরনের কটুক্তি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। ওই সম্মেলনগুলোতে যাদের নির্বাচিত করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই বির্তকিত। দলে অনুপ্রবেশকারি। বিএনপি-জামায়াত পরিবারের। তারা অর্থের বিনিময়ে কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। অথচ তিনি ত্যাগী ও সাধারণ মানুষজনসহ সর্বস্তরে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত তাকে পদ দেয়া হয়নি। তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

একই রকই অভিযোগ করেন, মহানগর তাজহাট থানার ২৮নং ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি নেছার আহম্মেদ তিনি বলেন, তিনি থানা সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু শীর্ষ নেতারা রাতের আধারে টাকার বিনিময়ে রাজাকার পরিবারের সদস্যকে সভাপতি পদ দিয়েছেন। বিভিন্ন পদে বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সদস্যদের পদ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এব্যাপারে কেন্দ্রে লিখিতভাবে অভিযোগ দেয়া হয়েছিলো বলে তিনি জানান।

হাজিরহাট ও মাহিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, বির্তকিত ব্যক্তিদের কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে। যারা এক সময় বিএনপি ও জামায়ত করতো। তারাও টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগে পদ পেয়েছে। অথচ আন্দোলনের সময় তারা কোথায়। দলের সুদিনে তারা সামনের সারিতে থাকতো। ফেসবুকে বড় বড় পোস্ট দিতো। দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করা হলো, আগুন দেয়া হয়, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয় ঠিক তখন তারা লাপাত্তা। এরা কি সত্যিকারে আওয়ামী লীগ করে এমন প্রশ্ন রাখেন তারা।

জানা গেছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে আহবায়ক কমিটি দিয়ে চলছে রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। কেন্দ্র থেকে বারবার নির্দেশনা দেয়ার পরও মহানগরের ছয়টি থানার পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়া হয়নি। আর ১৩ বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে ৩৩টি ওয়ার্ড। তবে মহানগরীর ছয়টি ওয়ার্ডে বিএনপি-জামায়াত পরিবারের অনেকেই অনুপ্রবেশ করায় বিভিন্ন নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে অভিযোগ করেছেন।

তবে কিছু নেতা দাবি করেন, ১৮ জুলাই জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তাণ্ডব ও অগ্নিযোগের পরপরই অবস্থান নিয়ে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী নাশকতাকারীদের ধাওয়া দেয়। পরে নেতাকর্মীরা নগরীর মুলাটোল এলাকার কোতোয়ালী থানার সামনে অবস্থান নেয়। এছাড়াও ঘটনার পর দলীয় কার্যালয় ছুটে আসেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতাকর্মী। তবে ঘটনার দুইদিনেও দলীয় কার্যালয়ে আসেননি রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান আহবায়ক কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।

ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা বলেন, যারা গর্তে লুকিয়ে আছেন, আশা করবো তারা সেখানেই থাকবেন। পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো হওয়ার পর মাঠে নামলে তাদের লজ্জিত হতে হবে আমাদের কাছে।

এদিকে ঘটনার সাতদিন পরে মামলা করেছে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। দেরিতে মামলা করায় তৃণমূলে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। মহানগরে মামলা করেছেন দলের যুগ্ম আহবায়ক আবুল কাশেম এবং জেলার পক্ষে মামলা করেছেন আওয়ামী লীগ জেলা কমিটির সদস্য জিন্নাত হোসেন লাভলু। মহানগরে ৭১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত কয়েকশো জনকে আসামি করা হয়। জেলায় ৬৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঘটনার সাতদিনেও মামলা না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে দলের অনেককে মন্তব্য করতে শোনা গেছে- জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নিজেদের কোন্দলে জর্জরিত। তাই নেতারা বাদী হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাফিয়ার রহমান বলেন, আমার মনে হয় ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে কারা দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে ঘুমিয়ে আছেন আর এই চরম মুহূর্তেও বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাদের চিহ্নিত করার সময় এসেছে। দলের সাংগঠনিক ভিত্তিকে গোছানো ও মজবুত না করতে পারলে সামনে এর চেয়েও বেশি ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, শীর্ষ নেতারা জানতো দলীয় কার্যালয়ে হামলা হতে পারে। কিন্তু তারা কর্মীদের নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান না নিয়ে কৌশলে আত্মগোপনে ছিলেন।

রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক এ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এসে এ তাণ্ডব চালিয়েছে। আর আমাদের উপজেলার নেতাকর্মীরা স্ব স্ব উপজেলায় অবস্থান নিয়েছিলো। তবে আমরা সেদিন দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিলে নাশকতাকারীরা এ তাণ্ডব চালাতে পারতো না।

রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক আবুল কাশেম বলেন, বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে আমরা দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমরা চলে আসার পরপরই হামলা হয়েছে।

স্বাআলো/এস

Share post:

Subscribe

Popular

আপনার জন্য
Related

ঐক্য ও সহমর্মিতায় সাহসী ও স্বনির্ভর জাতি গড়তে পারবো: ড. ইউনূস

ঢাকা অফিস: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সকলের...

খুলনায় ট্রেনের ধাক্কায় পথচারী নিহত

খুলনা ব্যুরো: খুলনা ট্রেনের ধাক্কায় হেলাল (৪৫) নামের এক...

বিস্ফোরক মামলায় বিএডিসির গুদামরক্ষক গ্রেফতার

জেলা প্রতিনিধি, নোয়াখালী: নোয়াখালী সদরে বিএডিসির গুদামরক্ষক ও যুবলীগ...

সাতক্ষীরায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বেপরোয়া গতির একটি মোটরসাইকেলের...