বৈশাখ মাস শুরু হতেই বাংলাদেশে বেড়েছে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের প্রকোপ। তীব্র গরম ও বাতাসে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পের উপস্থিতির কারণে এই সময়ে বজ্রগর্ভ মেঘ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়, যা ডেকে আনে ঘন ঘন বজ্রপাত। পরিবেশ দূষণের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে, কারণ প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায় বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক তথ্যে এর ভয়াবহতা স্পষ্ট। মাত্র একদিনেই দেশের ৯টি জেলায় বজ্রপাতে ১৪ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে কুমিল্লা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় সর্বাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
বজ্রপাত কেনো এবং কীভাবে হয়?
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, যেখানে দক্ষিণের গরম ও আর্দ্র বাতাসের সঙ্গে উত্তরের ঠান্ডা বাতাসের সংঘাত ঘটে, বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এই মেঘের মধ্যে কণাগুলোর সংঘর্ষে বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক চার্জ উৎপন্ন হয়। এই চার্জ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন তাকেই বজ্রপাত বলা হয়। সাধারণত এটি মাটিতে থাকা সবচেয়ে উঁচু বা নিকটবর্তী বস্তুর ওপর আঘাত হানে। বড় গাছপালা কেটে ফেলার ফলে খোলা জায়গায় বা মাঠে বজ্রপাতের আঘাত হানার ঝুঁকি বেড়েছে।
বজ্রপাতের প্রবণতা ও সময়:
১. বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে প্রায় ৮০ লাখ বজ্রপাত হয়।
২. বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
৩. সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় মে মাসে (মোটের প্রায় ২৬%)।
৪. মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে প্রায় ৫৯% এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩৬% বজ্রপাত সংঘটিত হয়।
৫. ঝুঁকির বিবেচনায় সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় হলো এপ্রিল থেকে জুন মাস।
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে করণীয়:
১. দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়: বজ্রপাতের পূর্বাভাস পেলে বা আবহাওয়া খারাপ দেখলে দ্রুত পাকা বাড়ির নিচে আশ্রয় নিন। খোলা জায়গায় বা মাঠে থাকবেন না।
২. ঘরের ভেতরে সতর্কতা: বাড়ির ভেতরে থাকলে জানালা ও দরজা বন্ধ রাখুন। ধাতব বস্তু বা দেয়াল স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
৩. বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন: বজ্রপাতের সময় বাড়ির সব ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সুইচ বন্ধ রাখুন এবং সম্ভব হলে প্লাগ খুলে দিন। মোবাইল ফোন বা ল্যান্ডফোন ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। ইন্টারনেট বা ডিশ লাইনের তার থেকে দূরে থাকুন।
৪. গাড়ির ভেতরে: গাড়ির ভেতরে থাকলে কাঁচ তুলে ধাতব অংশ স্পর্শ না করে বসে থাকুন।
৫. খোলা জায়গায় থাকলে: কোনো নিরাপদ আশ্রয় না পেলে খোলা জায়গায় কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ুন। মাটিতে শুয়ে পড়বেন না বা হাত রাখবেন না।
৬. উঁচু স্থান পরিহার: গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি বা উঁচু কোনো কাঠামোর নিচে আশ্রয় নেবেন না।
৭. জলাশয় এড়িয়ে চলুন: পুকুর, নদী বা যেকোনো জলাশয়ে থাকলে বা কাছাকাছি থাকলে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসুন বা উঠে পড়ুন।
যা একেবারেই করবেন না:
১. খোলা মাঠ, উঁচু স্থান বা জলাশয়ের পাশে থাকবেন না।
২. বাড়ির ভেতরে থাকলেও দরজা বা জানালার কাছে দাঁড়াবেন না।
৩. বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।
৪. বসে থাকলে মাটির সাথে শরীরের সংস্পর্শ যথাসম্ভব কম রাখুন এবং দুই হাত দিয়ে কান ঢেকে রাখুন।
বজ্রপাতে আহত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা:
বজ্রপাত সরাসরি হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কেউ বজ্রপাতে আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে বা শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস (সিপিআর) দিতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে, প্রয়োজনীয় সতর্কতা এবং সচেতনতা অবলম্বন করে এই দুর্যোগে প্রাণহানির ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বিশেষ করে যারা কৃষি বা অন্য কোনো প্রয়োজনে খোলা মাঠে কাজ করেন, তাদের জন্য এই সময়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।
স্বাআলো/এস